আমিনুল ইসলাম রানা, গোয়ালন্দ (রাজবাড়ী)

  ০৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

শিক্ষার সুযোগ বঞ্চিত বেদে শিশুরা

রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া ক্যানেল ঘাট মরা পদ্মা নদীর জেগে উঠা চরে বেদে সম্প্রদায়ের বসবাস। এই সম্প্রদায়ের পূর্ব পুরুষের পেশাগত কারণে সামাজিক ভাবে অবহেলিত ও অভিভাবকদের সচেতনতার অভাবে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত তাদের শিশুরা। জীবন-জীবিকার তাগিদে অনেক বেদে দল বেধে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ঘুরে বেড়ায়। কোথাও স্থায়ী ভাবে বসবাস না করায় পরিবারের সঙ্গে যাযাবরের মতো জীবন কাটে শিশুদেরও। বিদ্যালয় তাই চোখে পড়ে না বেদে শিশুদের। শিক্ষাগ্রহণের মতো মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিতই থাকে তারা।

জানা গেছে, একজন কোমলমতি শিশুর হাতে যখন বই-খাতা থাকার কথা, তখন বেদে শিশুর হাতে তুলে দেওয়া হয় সাপের বাক্স। বেরিয়ে পড়তে হয় পরিবারের আহার জোটাতে। মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে সাপ, বাঁদর খেলার মতো ভয়ঙ্কর পেশায় জড়িত বেদে সম্প্রদায়ের শিশুরা। বাবা-মায়ের দেখাদেখি ছোট থেকেই এসব পেশায় জড়িয়ে পড়ছে এ সম্প্রদায়ের তারা। বেড়ে উঠছে অশিক্ষা-কুশিক্ষায়। তাদের কাছে শিক্ষা বলতে, সাপ ও বাঁদর খেলা শেখা। হাটে-বাজারে সাপ, বাঁদর খেলায় বাবা-মাকে সহযোগিতা করাই তাদের মূল কাজ।

সরেজমিনে গোয়ালন্দ উপজেলার মরা পদ্মা নদীর জেগে উঠা চরের দেখা গেছে, পলিথিন ও ছেঁড়া-ফাটা কাপড় দিয়ে তৈরি অস্থায়ী বেদে পল্লী। পাবনা জেলার তালগাছি চরে দুই মাস বসবাস করে ওখানে এক সাপ্তাহ ধরে শতাধিক বেদে পুরুষ, নারী, শিশু মিলে বসবাস করছে এখানে এসে। মাঘ মাসের শীতের মধ্যে ও বেদে পল্লীর শিশুদের গায়ে শীতের পোশাক দেখা য়ায়নি। নারী পুরুষ মিলে পলেথীন দিয়ে ঘেরা একটি টয়লেট, ভিজা মাটির উপর বিছানা করে রাত যাপন করেছে এই ভ্রাম্যমান বেদে পল্লীর মানুষেরা। তাদের সঙ্গে থাকা শিশুরাও এভাবেই অন্ধকারে পরে আছে। বঞ্চিত হচ্ছে শিক্ষার আলো থেকে।

ওই বেদে পল্লীর শিশু রুমানা আক্তার (১০) বলেন, কোন দিন স্কুলে যাইনি, গ্রামের ছেলে মেয়েদের স্কুলে যেতে দেখে আমারও স্কুলে যেতে মন চায়। আমাদের বেদে পল্লীর ছেলে মেয়েদের স্কুলে যেতে কেও বলে না। ভোর হলেই আমরা বাবা মায়ের সঙ্গে গ্রামের পাড়া-মহল্লায় ঘুরে বেড়াই। গ্রামের শিশুদের খেলা দেখাই। লেখা পড়া করে আমারা অন্য পেশায় কাজ করতে চাই।

বেদেনী খোদেজা বেগম (৪০) বলেন, আমাদের বেদে পল্লীতে অবিবাহিত মেয়ে রয়েছে। তাদেরকে নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরতে হয়। আমাদের মেয়েদের গ্রামের ছেলেরা বিবাহ করতে চায় না। এ কারণে বেদে পল্লীর পুরুষেরা একাধিক বিবাহে জড়িয়ে পড়ে। বেদে শিশুদের পড়াশোনার আগ্রহ থাকলেও এদের শিক্ষার ক্ষেত্রে কেও এগিয়ে আসে না।

বেদে সর্দার শফিকুল ইসলাম (৪০) বলেন, সারাদিন গ্রাম ঘুরে ফিরতে প্রায়ই সন্ধ্যা হয়ে যায়। মাঝে মধ্যেই আমাদের সাহায্যের জন্য শিশুদের নিয়ে যাই। এখন থেকেই তাকে পেশাগত সব বিষয় জানতে হবে। নইলে বড় হয়ে কি করে খাবে তারা। তিনি দুঃখ করে আরো বলেন, জেল খানায়ও খাদ্য, চিকিৎসা, শিক্ষা ও নিরাপত্তার ব্যাবস্থা রয়েছে। যা বেদেদের নেই। রোহিঙ্গাদের জন্য দেশি বিদেশি সাহয্য আসে, বেদে পল্লীর জন্য কিছুই আসে না। শহরে এখন আমাদের আদিম চিকিৎসা চলে না। আমরা চরঞ্চলের গ্রাম গঞ্জে পরিবার নিয়ে ভিক্ষা করার মতো চেয়ে চিন্তে খাবার খাই। গ্রামে গঞ্জে টুকিটাকি চিকিৎসা করালেও জিনিস পত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় গ্রামের মানুষ নগদ টাকা দিতে পারে না। দু এক কেজি চাউল, আটা দিয়ে আমাদের বিদায় করে।

বেদে পল্লীর আরেকজন দুলাল সর্দার (৬৫) বলেন, কোনো অভিভাবক চায় না তার সন্তান অশিক্ষিত থাকুক। কিন্তু আমাদের যে আয় তাতে সন্তানদের পডাশুনা চালানো কঠিন। আমাদের ২৫ টি পরিবারে মোট ৩০ জন শিশু রয়েছে। এদের ১৫ জনেরই বয়স ৮ বছরের উপরে। বিয়ের উপযুক্ত মেয়েও রয়েছে এখানে। তারা কেউ স্কুলে যায় না।

নিজের নাম টাও লেখতে পারেনা তারা। সরকারি ভাবে বই খাতা দিলে শিশুদের আমারা নিজেরাও অক্ষরজ্ঞান হিসাবে গড়ে তুলতে পারতাম।

বারেয়া ইদ্রিস মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ মো. আ. কাদের শেখ বলেন, বেদে সম্প্রদায় দেশের নাগরিক। শিক্ষা গ্রহণ একজন নাগরিকের মৌলিক অধিকার। বেদে পল্লীর শিশুদের স্কুলে ভর্তির সুযোগ করে দেওয়ার দরকার। তারা অন্যত্র চলে গেলে সেই স্থানের স্কুলে ভর্তি করে পড়াশোনা করার সুযোগ করে দেওয়ার উচিত। এই শিশুদের শিক্ষাদানের জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close