এইচ আর তুহিন, যশোর

  ২১ নভেম্বর, ২০২২

যশোরে গুড়-পাটালি

৪৩ কোটি টাকা আয়ের লক্ষ্য

‘যশোরের যশ খেজুর রস’ কথাটি আজও দেশ-বিদেশের মাটিতে সমাদৃত। আধুনিকতার ছোঁয়ায় খেজুর গাছ কমলেও টিকে আছে রস-গুড় ও পাটালির জৌলুস। এখন পুরোদমে চলছে খেজুর গুড় ও পাটালি তৈরির কাজ। চলতি মৌসুমে এ অঞ্চলের হাজার হাজার কৃষকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে খেজুর রস ও গুড় উৎপাদন।

পুরো মৌসুম জুড়ে গাছ কাটা, রস সংগ্রহ, গুড়-পাটালি তৈরি ও বাজারজাতকরণের সঙ্গে এ অঞ্চলের প্রায় এক লাখ পরিবার ব্যস্ত সময় পার করে থাকে। যশোরের খাজুরা ও ছাতিয়ানতলা এলাকায় সবার্ধিক গুড় উৎপাদন হয়।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর যশোরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক (ক্রপ) মো. আবু তালহা বলেন, যশোরের প্রায় এক-চতুর্থাংশ খেজুরগাছ ইতোমধ্যে কাটা হয়েছে। আহরণ করা হচ্ছে রস। ‘যশোরে ১৬ লাখ ৪১ হাজার ১৫৫টি খেজুর গাছ আছে। এর মধ্যে ৩ লাখ ৪৯ হাজার ৯৫৫টি গাছ থেকে খেজুরের রস আহরণ করা হয়। এর সঙ্গে প্রায় ১৩ হাজার ৫০০ কৃষক সম্পৃক্ত। তবে এ খাতে লাখো পরিবারের সম্পর্ক রয়েছে। যশোর জেলায় এক মৌসুমে প্রায় ৫৩ লাখ লিটার গুড় উৎপাদন হয়; যার বাজারমূল্য প্রায় ৪৩ কোটি টাকা। ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখার পাশাপাশি খেজুরের রস ও গুড়ের ব্যবসাকে লাভজনক করতে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।

গুড়-পাটালিতে লাখ পরিবারে ব্যস্ততা : খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাত করে গুড়-পাটালি তৈরি করে সংসার চালাচ্ছে এমন অসংখ্য পরিবার রয়েছে যশোরে। শীত মৌসুমের ৫ মাসের পরিশ্রমে এই কয় মাস ছাড়াও চলে আরও তিন মাস।

রস সংগ্রহকারী (গাছি), রস সংগ্রহের ভাড় তৈরির কাজ, গাছি দা তৈরি, গাছে উঠতে দা বহন করার জন্য পাত্র (বাঁশের তৈরি ঠুঙ্গি) তৈরির কাজে নিয়োজিত কামার ও মুচি, পরিবহন শ্রমিক এবং পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ী সব মিলে লক্ষাধিক পরিবারের কর্মকসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে খেজুর রস-গুড় উৎপাদন খাত।

কিসমত রাজাপুর এলাকার গাছি ওয়াহিদুজ্জামান জানান, একটি গাছ থেকে মৌসুমে (পাঁচ মাস) প্রায় ১২০০ টাকার গুড় পাওয়া যায়। যদি কোনো গাছি এক পণ (৮০টি) গাছ রস সংগ্রহের জন্য কাটেন তাহলে তিনি এক মৌসুমে ৯৬ হাজার টাকা থেকে লাখ টাকা আয় করতে পারেন। বর্তমানে খেুজর গুড় ৩৫০ টাকা কেজি ও পাটালি ৪০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

গাছি আব্দুর রহমান জানান, এক যুগেরও বেশি গাছ কেটে আসছেন। শীত মৌসুমে রস, গুড় ও পাটালি বিক্রিই মূলত তার আয়ের প্রধান অংশ। বংশপরম্পরায় তিনি এই পেশার সঙ্গে রয়েছেন। তিনি স্বজনদেরও দিয়ে থাকেন এই রস আর গুড়। তিনি বলেন, ‘এ বছর মোট একশটি গাছ কাটবো। এর মধ্যে আমার নিজের ৬০টি আর প্রতিবেশীদের ৪০টি। প্রতিবেশীদের রসের অর্ধেক দিতে হয়।’ 

যশোর অঞ্চলের সবচেয়ে বড় গুড়-পাটালির মোকাম খাজুরা হাটের ইজারাদার চয়ন কুমার বসু জানান, সপ্তাহের দুই দিন (রবি ও বৃহস্পতিবার) হাট বসে। গাছিরা গুড়-পাটালি নিয়ে আসে এই হাটে। এখান থেকে পাইকারী ব্যবসায়ী গুড়-পাটালি পৌঁছে দিচ্ছে দেশের বিভিন্ন জেলায়। খাজুরার গুড়-পাটালির চাহিদা রয়েছে ব্যাপক।

রস-গুড়-পাটালি প্রস্তুত প্রক্রিয়া : অগ্রহায়ণ মাসে গাছগুলোকে রস সংগ্রহের উপযোগী করে তোলার জন্য গাছের পাতাসহ বাকল ধারালো দা দিয়ে চেঁছে পরিষ্কার করা হয়। স্থানীয় ভাষায় একে ‘গাছ তোলা’ বলা হয়। সাত-আট দিন পর পুনরায় পরিষ্কার করে আরো সাত-আট দিন পর চাঁছা অংশে বাঁশের নলি বসানো হয়। এর পর পালা করে সপ্তাহে দু’দিন করে প্রতিটি গাছ কাটা হয়। গাছ কাটার দিন যে রস পাওয়া যায় তাকে জিড়ান রস বলে। একটি গাছ একবার কাটলে ছয় লিটারের মতো রস পাওয়া যায়। আবহাওয়া যত শীতার্ত এবং আকাশ স্বচ্ছ থাকলে রস মিষ্টি ও পরিষ্কার হয়। সেই রস সংগ্রহ করে গুড় তৈরি করতে কয়েকটি ধাপ পার করতে হয়। জিড়ান রসের গুড় দানাদার করতে হলে জ্বালানির পাত্রে ঝাকি (খেজুর গাছের ডাটা দিয়ে তৈরি গুড় ঘোটার লাঠি) দিয়ে সামান্য জায়গায় কিছুক্ষণ ঘষলে ওই জায়গার গুড় শুকিয়ে গুড়ো হয়ে যায়। এই প্রক্রিয়াকে ‘বীজমারা’ বলে। এই বীজ গুড়ের সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিলে গুড়ে দানা বাঁধে। এই গুড় দিয়েই তৈরি হয় রসালো সুস্বাদু পাটালি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close