ইউসুফ আলী সুমন, মহাদেবপুর (নওগাঁ)

  ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২

মাটিবাহী ট্রাক্টরে অন্তত ১১ জনের মৃত্যু

মহাদেবপুরে খাদ্য সংরক্ষণাগার প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ

খাদ্য নিরাপত্তা ও বিজ্ঞানসম্মত সংরক্ষণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে বরেন্দ্র অঞ্চলে ৪৮ হাজার টন ধারণক্ষমতাসম্পন্ন আধুনিক স্টিল সাইলো নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সরকার। এজন্য গত বছর নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার ভীমপুর মৌজায় জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এখন চলছে ভূমি উন্নয়ন কাজ। সরকারি প্রকল্পের স্থান বালু দিয়ে ভরাট করা হলেও এই প্রকল্প এলাকা ভরাটে ব্যবহার করা হচ্ছে এটেলমাটি ও পুকুরের কাদামাটি।

কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অনিয়মণ্ডদুর্নীতির অভিযোগ স্থানীয় সচেতন মহল ও এলাকাবাসীর। এছাড়া প্রকল্পের কাজে ব্যবহৃত মাটিবাহী অবৈধ ট্রাক্টর ও ডাম্পার ট্রাকের বেপরোয়া চলাচলে নওগাঁ-রাজশাহী মহাসড়কে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছেন অনেকে।

খাদ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইট সূত্রে জানা যায়, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ‘আধুনিক খাদ্য সংরক্ষণাগার নির্মাণ প্রকল্প’ বাস্তবায়ন করছে খাদ্য অধিদপ্তর। ২০১৪ সালের জানুয়ারীতে শুরু হয়ে প্রকল্পটি শেষ হবে ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) ২য় সংশোধিত ডিপিপি অনুযায়ী অনুমোদিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৫৬৮ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। এই অর্থের মধ্যে বিশ্বব্যাংক সহায়তা করছে ৩ হাজার ৪৯৯ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। নওগাঁর মহাদেবপুর ছাড়াও প্রকল্পটির আওতায় আশুগঞ্জ, ময়মনসিংহ, মধুপুর, বরিশাল, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও মহেশ্বরপাশা আরও ৭টি সাইলো নির্মাণ করা হচ্ছে। এরমধ্যে ছয়টি চাল ও দুটি গম সাইলো। অন্যান্য সাইলো কংক্রিট দিয়ে নির্মিত হলেও এসব নির্মাণ করা হবে সম্পূর্ণ স্টিল দিয়ে। প্রকল্পের কাজ শেষ হলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা সুনিশ্চিত হবে বলে আশা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

নওগাঁ জেলা প্রশাসন ও খাদ্য বিভাগ সূত্রে জানা যায়, নওগাঁ-রাজশাহী আঞ্চলিক মহাসড়ক সংলগ্ন ভীমপুর এলাকার ফয়েজ উদ্দিন কোল্ড ষ্টোরেজের পাশে সাইলো নির্মাণের জন্য ১৫ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এজন্য সরকারের ব্যয় হয়েছে ১০ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা প্রকল্প এলাকায় উপস্থিত হয়ে খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের কাছে সে জমি বুঝে দেন। সাইলোটি নির্মিত হলে উত্তরাঞ্চলের শস্যভান্ডার খ্যাত নওগাঁর ১১ উপজেলা ও এর আশেপাশের জেলা-উপজেলাগুলোতে উৎপাদিত উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য সরকারিভাবে সংগ্রহ করা সহজ হবে বলে প্রত্যাশা করছেন খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তারা। রাজশাহী আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের আঞ্চলিক রক্ষণাবেক্ষণ প্রকৌশলীর দেয়া তথ্যমতে, মহাদেবপুর উপজেলার ভীমপুরে প্রকল্পের ভূমি উন্নয়নের জন্য যৌথভাবে কার্যাদেশ পেয়েছেন ঢাকার মেসার্স চন্দ্রদ্বীপ কনট্রাকশন, রাজশাহীর মেসার্স ডন এন্টারপ্রাইজ ও নওগাঁর মেসার্স ইথেন এন্টারপ্রাইজ। গত ১০ মার্চ শুরু হয়ে ভূমি উন্নয়ন কাজ শেষ হবে ৩ সেপ্টেম্বর। এতে প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে পাঁচ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান দেবে খাদ্য অধিদপ্ত।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রকল্পের ভরাট কাজ শুরু হওয়ার পর থেকে সড়কে মাটিবাহী শতাধিক অবৈধ ট্রাক্টর ও ১০ চাকার ডাম্পার ট্রাকের বেপরোয়া চলাচল বেড়েছে। এতে অতিষ্ঠ এলাকাবাসি। ঘটছে সড়ক দুর্ঘটনা। একের পর এক ঝরে যাচ্ছে তাজা প্রাণ। গত ১৩ আগস্ট নওগাঁ-রাজশাহী মহাসড়কে প্রকল্প এলাকায় মাটিবাহী ট্রাক্টরকে সাইড দিতে গিয়ে প্রাইভেট কার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদের পানিতে ডুবে জেলার মান্দা উপজেলার কুলিহার গ্রামের শিমুল হোসেন (৩২) ও তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী জিনিয়া খাতুনের (২৪) মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। এর মাত্র সাত ঘন্টার ব্যবধানে একই সড়কে দুটি মোটরসাইকেল এর মুখোমুখি সংঘর্ষে বাবা ও ছেলের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এছাড়া গত ২৪ জুন বাবলাতলী মোড়ে প্রকল্পের ভরাট কাজে ব্যবহৃত ট্রাক্টরের কারণে ট্রাকের সঙ্গে সিএনজিচালিত অটোরিকশার সংঘর্ষে চার শিক্ষকসহ পাঁচ জনের মৃত্যু হয়। এদিকে নওগাঁ-রাজশাহী সহাসড়কে দুর্ঘটনার নেপথ্যে দায়ী মাটিবাহী অবৈধ ট্রাক্টরের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ করার দাবিতে সম্প্রতি উপজেলার নওহাটা মোড়ে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে প্রথম সংবাদ বন্ধু ফোরাম ও সচেতন এলাকাবাসি। মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, গত ৩-৪ মাসে মাটিবাহী ট্রাক্টর ও ট্রাকের কারণে সৃষ্ট পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় অন্তত ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে। দোআঁশ মাটি দিয়ে ভরাট করার কথা থাকলেও তা করা হচ্ছে এঁটেলমাটি ও পুকুরের গলামাটি দিয়ে। এঁটেলমাটি দিয়ে ভরাট করে কোনো কনস্ট্রাকশন করলে টেকসই হবে না। কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে কার্যাদেশপ্রাপ্ত ঠিকাদাররা প্রকল্পের ভরাট কাজ প্রাক্কলিত ব্যয়ের চেয়ে কমমূল্যে বলিহার বাজারের একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করে কোটি টাকা ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছেন বলে দাবি করেন বক্তারা।

সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, সাইলো নির্মাণে ভীমপুর মৌজায় গত কয়েক মাস থেকে প্রায় শতাধিক অবৈধ ট্রাক্টর ও ডাম্পার ট্রাক দিয়ে মাটি ভরাট কাজ করছে নওগাঁর সদর উপজেলার বলিহার বাজারের মো. জাহাঙ্গীর আলম নামের একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন এলাকার কৃষি জমিতে পুকুর খনন করে এঁটেলমাটি ও মজা পুকুরের গলামাটি এনে চলছে ভরাট কাজ। সেখানে খাদ্য বিভাগ থেকে কার্যাদেশপ্রাপ্ত মেসার্স চন্দ্রদ্বীপ কনট্রাকশন, মেসার্স ডন এন্টারপ্রাইজ ও মেসার্স ইথেন এন্টারপ্রাইজের কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। অপরিকল্পিতভাবে রাস্তার চেয়ে সরু একটি ব্রিজের পাশদিয়ে প্রকল্প এলাকায় যাতায়াতের রাস্তা তৈরি করায় ব্যস্ততম নওগাঁ-রাজশাহী মহাসড়ক মরণ ফাঁদে পরিণত হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী কার্যস্থলে বিবরণ সম্বলিত সাইনবোর্ড দৃশ্যমান থাকার কথা থাকলেও তা টানানো হয়নি। ফলে এ প্রকল্পের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। প্রকল্প এলাকায় গিয়ে কথা হয় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটির দ্বিতীয় ম্যানেজারের দায়িত্বে থাকা বিদ্যুৎ মন্ডলের সাথে। জানতে চাইলে তিনি জানান, গত ৩ মাস থেকে ভরাট কাজ করছে বলিহার বাজারের জাহাঙ্গীর আলম নামের ঠিকাদার। ২-৩ বছর পুকুর কন্ট্রাক নিয়ে গলামাটি তুলে এনে ভরাট করা হচ্ছে। শতকরা ৯০ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। তাদের মাটিবাহী যানবাহনের কারণে কোনো সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেনি এবং কারও মৃত্যু হয়নি বলে দাবি তার।

খাদ্য বিভাগ থেকে কার্যাদেশপ্রাপ্ত নওগাঁর মেসার্স ইথেন এন্টারপ্রাইজ প্রাইভেট লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী ইকবাল শাহরিয়ার রাসেল জানান, সরকারি প্রকল্পের কাজ বেচা-কেটার সুযোগ নেই। সাপ্লায়ারের মাধ্যমে মাটি ক্রয় করে তার প্রতিষ্ঠান ভরাট কাজ করছে বলে দাবি করেন তিনি। এ ব্যাপারে ঢাকার মেসার্স চন্দ্রদ্বীপ কনট্রাকশন ও রাজশাহীর মেসার্স ডন এন্টারপ্রাইজের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। রাজশাহী আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের আঞ্চলিক রক্ষণাবেক্ষণ প্রকৌশলী আবু তাহের জানান, প্রকল্প এলাকায় মাটি ভরাট কাজ চলছে। তারা নিয়মিত খোঁজখবর নিচ্ছেন ও প্রকল্প পরিদর্শন করছেন। কাজ শুরুর আগে সার্ভে করা হয়েছে এবং ভরাট কাজ শেষে সার্ভে করে বিল প্রদান করা হবে। সরকারি প্রকল্পের কাজ বেচা-কেনার কোনোই সুযোগ নেই। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানগুলো শতকরা ৫০ শতাংশ বিল এখন পর্যন্ত নিতে পারেননি। খাদ্যমন্ত্রী নিজেও প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করেছেন বলেও জানান এই প্রকৌশলী। অবৈধ যানবাহনের বিষয়ে নওগাঁ জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট খালিদ মেহেদী হাসান জানান, নিয়মিত অভিযান অব্যাহত রয়েছে। সড়কে দুর্ঘটনা কমাতে কাঁকড়া (ট্রক্টর), ট্রলি ও অন্যান্য যানবাহন দ্বারা মাটি পরিবহনে রাস্তার উপর যাতে মাটি না পড়ে সেজন্য গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেছে জেলা প্রশাসন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close