কাইয়ুম আহমেদ

  ১৫ আগস্ট, ২০২১

ধরিত্রী থমকে গিয়েছিল...

‘এসেছে কান্নার দিন, কাঁদো বাঙালি, কাঁদো/ তোমার বক্ষমুক্ত ক্রন্দনের আবেগী উচ্ছ্বাসে/আজ ভেসে যাক, ডুবে যাক এই ব-দ্বীপ।/ মানুষের একত্রিত কান্না কত সুন্দর হতে পারে,/ মানুষ জানে না। এবার জানাও। সবাই জানুক।/ মাটি থেকে উঠে আসা ঝিঁঝির কান্নার মতো/ তোমাদের কল্লোলিত ক্রন্দনের ধ্বনি শুনুক পৃথিবী।/ কাঁদো, তুমি পৃথিবী কাঁপিয়ে কাঁদো।’ সত্যিই আজ কাঁদার দিন। আজ সেই ভয়াল-বীভৎস ভোর। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ভোরে থমকে গিয়েছিল ধরিত্রী। ফুঁপিয়ে কাঁদছিল বাতাস। সেদিন বাতাস কেঁদেছিল, আকাশের চোখেও ছিল জল। গাছের পাতারা শোকে সেদিন ঝরেছে অবিরল। ভয়ার্ত সেই শোক জেগে আছে রক্তরাঙা পতাকায়, বাংলায়।

সৈয়দ শামসুল হক তার ‘আমার পরিচয়’ কবিতায় বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে লিখেছেন ‘এই ইতিহাস ভুলে যাবো আজ, আমি কি তেমন সন্তান?/যখন আমার জনকের নাম শেখ মুজিবুর রহমান;/তারই ইতিহাস প্রেরণায় আমি বাংলায় পথ চলি-/ চোখে নীলাকাশ, বুকে বিশ্বাস, পায়ে উর্বর পলি।’

বাংলাদেশের অভ্যুদয় নিয়ে কবি অন্নদাশঙ্কর রায় লিখেছিলেন, ‘সাতচল্লিশ সালের আগে আমরা কেউ স্বপ্নেও ভাবিনি যে, বঙ্গ দুভাগ হবে। দুই ভাগের নাম পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গ। এরপর কেটে গেল চব্বিশ বছর। আমরা যারা এপারে বাস করি তারা ভাবতেই পারিনি যে, ওপারে একটা মুক্তিযুদ্ধ বাধবে। আমরা খবরই রাখতুম না যে, শেখ মুজিবুর রহমান তার সহকর্মীদের জিজ্ঞাসা করবেন, ‘আমাদের দেশ যখন স্বাধীন হবে, তখন তার নাম কী হবে?’ এর উত্তরে একজন বলবেন, ‘পূর্ব বাংলা’ আর একজন বলবেন, ‘পাক বাংলা’। মুজিবুর রহমান তখন বলেন, ‘না, আমাদের দেশের নাম হবে বাংলাদেশ।’ তিনিই স্থির করেন, জাতীয় সংগীত হবে ‘আমার সোনার বাংলা’।

বাংলাদেশ নামটির একটি ঐতিহ্য ছিল আর সোনার বাংলা গানটির একটি জাদু ছিল। অমন প্রেরণাদায়ক নাম ও গান আর ছিল না। লাখ লাখ মানুষ অকাতরে প্রাণ দিল এই প্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়ে। নয় মাস তুমুল যুদ্ধের পর দেশ যখন স্বাধীন হলো, তখন তার নাম রাখা হলো গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে একাত্তরের পরাজিত শক্তি বাংলাদেশকেই হত্যা করতে চেয়েছিল। পৃথিবীর মানচিত্র

থেকে মুছে দিতে চেয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত দেশটিকে। সেদিন ঘাতকরা হত্যা করেছিল বঙ্গবন্ধুর নশ্বর শরীরকে, কিন্তু তার অবিনশ্বর চেতনা ও আদর্শ মৃত্যুঞ্জয়ী। ইতিহাসের মহানায়কের অস্তিত্ব আজও জানান দেয় বাংলার সবুজ-শ্যামল প্রকৃতি।

১৫ আগস্ট ভোরে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার দিনটি ছিল ভারতের স্বাধীনতা দিবস। সেই উপলক্ষে অন্নদাশঙ্কর ‘প্রীতি সম্মেলনে’ আমন্ত্রিত হয়েছিলেন রাজভবনে। সেখানেই এই মর্মান্তিক শোকাবহ খবরটি তিনি শোনেন তার এক বন্ধুর কাছে। অবিশ্বাস্য খবরটি তিনি ওই আসরে উপস্থিত আর এক বন্ধুর কাছ থেকেও যাচাই করে নেন। এই শোক তার অন্তরকে কাতর করে তোলে, ‘মনজুড়ে ধ্বনি উঠে, হে মোর দুর্ভাগা দেশ’।

অন্নদাশঙ্কর প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যত দিন বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার না হবে, তত দিন তিনি বাংলাদেশে আসবেন না। সে কথা রেখেছিলেন তিনি; বলেছিলেন, ‘এই দেশ আমার প্রিয় দেশ। এই দেশের মানুষ আমার প্রিয় মানুষ। আমি এই দেশের প্রতি নাড়ির টান অনুভব করি। এই দেশের মানুষের সঙ্গে আমার আত্মীয়তার ডোর পঞ্চাশ বছরেও ছিন্ন হয়নি। যত দিন না মুজিব হত্যার প্রতিবাদ হচ্ছে ও মুজিবের স্মৃতিসৌধ নির্মিত হচ্ছে, তত দিন আমি বাংলাদেশে যাব না।’

তার প্রত্যাশা পূরণ হয়। তিনি ‘বিজয় উৎসবের রজতজয়ন্তী উপলক্ষে’ ১৯৯৬ সালে বিশেষ অতিথি হিসেবে ঢাকায় আসেন।

দীর্ঘ ব্যবধানে তার স্মৃতির শহর ঢাকায় এসে যা দেখেন, তাতে খানিক বিস্মিত, খানিক উৎফুল্ল, খানিক হতাশ হন। তবে তিনি খুশি হন একুশ বছরের জমাটবাঁধা দুঃখ-কষ্ট-শোকের নিরসন-প্রয়াসে। ঢাকায় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপে তিনি সফর সম্পর্কে বলেন, ‘আমি খুব খুশি হয়েছি। এতকাল পরে একটা অন্যায়ের প্রতিকার হলো, যারা মুজিবকে হত্যা করেছিল, সেই ঘাতকদের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া অসহায়, এতিম মেয়েটি যে আবার এ দেশের প্রধানমন্ত্রী হবে, এটা কেউ ভাবতে পারেনি। খুব খুশি হয়েছি। খুব খুশি হয়েছি। মৃত্যুর আগে আমি মুজিব হত্যার বিচার এবং খুনিদের উপযুক্ত শাস্তি দেখে যেতে পারলে আমার কষ্ট লাঘব হবে।’

আদালতের রায়ে আত্মস্বীকৃত সব ঘাতকই সর্বোচ্চ দ-ে দ-িত হয়। পলাতক ছাড়া, বঙ্গবন্ধুর খুনি অন্য আসামিদের দ- যথারীতি কার্যকর হয়। দীর্ঘদিন পর দেশ হয় কলঙ্কমুক্ত।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close