সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

  ১৭ মার্চ, ২০২০

কেন জানতে হবে বঙ্গবন্ধুকে

বঙ্গবন্ধুর কর্মময় জীবনের দিকে তাকালে অনেক শিক্ষণীয় বিষয় পাই, যা আমাদের তরুণ প্রজন্মের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথমত, তার দেশপ্রেম এবং মানুষের প্রতি তার সহমর্মিতার বিষয়টি উল্লেখ করা যায়। তার জীবনের উদ্দেশ্য ছিল দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো, তার রাজনীতির উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশকে স্বাধীন করা। এ দুই কাজেই তিনি সফল হয়েছিলেন। তিনি একটি স্থির লক্ষ্য নির্দিষ্ট করে, সেই পথে যাত্রা শুরু করে তা থেকে বিচ্যুত হননি।

এ থেকে দ্বিতীয় শিক্ষণীয় বিষয়টি পরিষ্কার হয়, যা হচ্ছে দৃঢ়চিত্ততা, সংকল্প ও কর্মোদ্যম। তিনি যে অবস্থানেই কর্মরত ছিলেন ছাত্রনেতা, স্থানীয় পর্যায়ের নেতা বা জাতীয় পর্যায়ের রাষ্ট্রনেতা প্রতিটি বিষয়কে তিনি গভীর অভিনিবেশ দিয়ে ভাবতেন, তার সংকল্প নির্ধারণ করতেন এবং স্থির চিত্তে সেটিকে এগিয়ে নিয়ে যেতেন।

তৃতীয় শিক্ষণীয় বিষয়টি ছিল জীবনের প্রতিকূলতাগুলোকে সহজভাবে নেওয়া, যে কারণে দীর্ঘ কারাবাসেও তিনি বিচলিত হননি; যেকোনো বিপর্যয়ে তিনি চিত্তের স্থিরতা হারাননি এবং চরম দুর্বিপাকেও তার লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হননি। চতুর্থ যে বিষয়টি এ প্রজন্মের তরুণদের জন্য বিশেষভাবে প্রয়োজন সেটি হচ্ছেÑ স্থানীয় চিন্তার সঙ্গে বৈশ্বিক চিন্তার একটি মিলন ঘটানো।

‘বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থ পাঠে জানা যায়, তিনি তার সমস্ত জীবন বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়িয়েছেন; স্থানীয় জ্ঞান তাকে রাজনীতিতে একটি বিশেষ শক্তি অর্জনে সহায়তা করেছে। যখনই তিনি নেতৃত্বের আসনে চলে এলেন, তিনি বাংলাদেশকে একটি বৈশ্বিক আসনে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করলেন এবং বিশ্ব তাকে যেভাবে গ্রহণ করল, তাতে প্রমাণিত হলো স্থানীয় পর্যায় থেকে বৈশ্বিক পর্যায় পর্যন্ত যাওয়ার মতো সক্ষমতা তার ছিল। এই স্থিতিস্থাপকতাটি নেতৃত্বের এক বিশাল গুণ। এটি সব পর্যায়ে সব ক্ষেত্রে আমরা প্রয়োগ করতে পারি। বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান শিক্ষার সঙ্গে মানবিক শিক্ষাকেও মেলানোর কথা বলেছেন। তিনি প্রযুক্তির সক্ষমতার সঙ্গে আমাদের স্থানীয় জ্ঞানকে ধারণ করতে বলেছেন। এটিও আমি মনে করি এ প্রজন্মের তরুণদের জন্য একটি প্রয়োজনীয় বিষয়।

বঙ্গবন্ধু আরো যে কারণে আমাদের কাছে প্রয়োজনীয় তা তার অসাম্প্রদায়িক এবং প্রবলভাবে মানবিক চিন্তা-চেতনার জন্য। বিভেদ-বিভাজনের এ যুগে যখন রাজনৈতিক মতপাথর্ক্য মানুষকে সৌজন্য থেকে দূরে সরিয়ে দেয়Ñ বঙ্গবন্ধুর স্বাভাবিক সৌজন্য, মানবিকতা এবং মানুষের প্রতি, এমনকি প্রতিপক্ষের প্রতি সম্মান দেখানোর চর্চাটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়। ৭ মার্চের ভাষণে তিনি ইয়াহিয়া খান ও ভুট্টোকে ইয়াহিয়া সাহেব ও ভুট্টো সাহেব বলে সম্বোধন করেছেন। তাদের প্রতি

অশ্রদ্ধা দেখাননি; কিন্তু রাজনীতির মাঠে তাদের পরাস্ত করেছেন।

তাদের ইতিহাসের ভাগাড়ে নিক্ষেপ করেছেন। অর্থাৎ রাজনৈতিক শক্তি যেখানে প্রয়োগ করার সেখানে তা করেছেন;

যেখানে মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করতে হয়, সেখানে তা তিনি করেছেন। যার জন্য তার রাজনীতিতে মানবিক মূল্যবোধের বিষয়টি স্বভাবতই চলে এসেছে; আমাদের সময়ে যেটির অভাব দেখতে পাচ্ছি।

আমি বঙ্গবন্ধুকে অনুসরণ করা শুরু করি ১৯৬৬ সালে, ছয় দফা ঘোষণার পর থেকেই, যখন একবার তিনি সিলেট গেলেন। তার বাগ্মিতার আমি ছিলাম গুণমুগ্ধ। তার দৃঢ়চিত্ততা ও আত্মবিশ্বাসের আমি প্রশংসা করতাম এবং দেখতাম তার ভেতর নেতৃত্বের স্বাভাবিক গুণের সঙ্গে তিনি প্রান্তিক মানুষের বিনয়কে মিলিয়ে দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু প্রত্যেক কর্মীর নাম মনে রাখতেন, প্রত্যেক মানুষকে সম্মান দিতেন। মওলানা ভাসানীকে তিনি সম্মান জানিয়েছেন রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে; সেই দৃশ্য এখনো আমাদের চোখে ভাসে। আমি মনে করি, বঙ্গবন্ধুর এই সৌজন্য এবং মানুষকে সম্মান করার রীতিটি আমাদের সময়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়া প্রয়োজন। সবচেয়ে বড় কথা, বঙ্গবন্ধু আমাদের আত্মবিশ্বাস দিয়েছেন, জাতি হিসেবে যার চর্চা করা আমাদের প্রয়োজন। তিনি আমাদের অতীতকে সামনে এনে বর্তমানকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন, যাতে ভবিষ্যতের দিকে আমরা যেতে পারি সে রকম একটি ভূমি আমাদের দিয়েছেন। আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ যাত্রা যেন অব্যাহত রাখিÑ সেটিই বোধহয় বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা দেখানোর একটি ভালো উপায়। তিনি শতবর্ষী কিন্তু তিনি চিরন্তন।

বাংলাদেশে যত ক্রান্তিকাল আসবে, বঙ্গবন্ধুকে আমাদের বিশেষ করে প্রয়োজন পড়বে। তার কাছ থেকে আমরা অনুপ্রেরণা নেব, যাতে আমরা সামনে এগিয়ে যেতে পারি।

লেখক: শিক্ষাবিদ, কথাসাহিত্যিক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close