আবদুল মান্নান

  ১৭ মার্চ, ২০২০

বাঙালির একমাএ মহানায়ক

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

বিবিসির এক জরিপে নির্বাচিত হয়েছিলেন

হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে।

জরিপে অংশ নিয়েছিলেন বিবিসির

সাধারণ শ্রোতারা। এটি ২০০৪ সালের

কথা, যখন বাংলাদেশ খালেদা জিয়ার

নেতৃত্বে চারদলীয় শাসনের অধীনে। সেই

জরিপে বাংলাদেশ, ভারতসহ সারা বিশ্বের

বাঙালিরা অংশ নিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে

বিএনপিপন্থি সুধী সমাজের অনেক পন্ডিতজন এই

জরিপের সমালোচনা করেছিলেন এই বলে, রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিয়ে

বঙ্গবন্ধুকে বেছে নেওয়া কোনো অবস্থায়ই মেনে নেওয়া যায় না। সেই

জরিপে কবিগুরুর স্থান হয়েছিল দ্বিতীয় আর বাংলাদেশের প্রথম সামরিক শাসক বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়ার অবস্থান হয়েছিল তালিকার শেষ ব্যক্তি হিসেবে ২০তম। রবীন্দ্রনাথ প্রথম না হওয়াতে যারা আহত হয়েছিলেন তাদের বক্তব্য ছিল যিনি বিশ্বকবি, তিনি কেন এই তালিকার শীর্ষে নেই? তার জবাবে আমি একটি জাতীয় দৈনিকে লিখেছিলাম, রবীন্দ্রনাথ বিশ্বকবি তা ঠিক; কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে হয়তো কোনো একসময় আরেকজন কবির আবির্ভাব হতে পারে, যিনি নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হবেন, নন্দিত হবেন দেশে-বিদেশে, বিশ্বকবি অভিধায় ভূষিত হবেন। তা হয়তো হতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু একজন বাঙালি আজীবন সংগ্রাম করে, মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে বাঙালিদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছেন, তেমনটি ঘটার সম্ভাবনা শূন্যের কোঠায়, নেই বললেই চলে। সেই অসম্ভব কাজটি যিনি করেছেন তিনি শেখ মুজিব, বঙ্গবন্ধু, বাংলার বন্ধু। ১৭ মার্চ তার শততম জন্মবার্ষিকী। এই দিন থেকে শুরু হবে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী পালনের নানা কর্মসূচি। জন্মশতবার্ষিকী পালনের জন্য এরই মধ্যে দুটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রথমটি বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জাতীয় কমিটি, আর অন্যটি জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে কর্মসূচি বাস্তবায়ন কমিটি। ১৯৭১ সালের ১৭ মার্চ বাঙালির ইতিহাসের এক উত্তাল সময়ে একদল বিদেশি সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুর কাছে জানতে চেয়েছিলেন, তিনি তার জন্মদিন কিভাবে পালন করছেন? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, তিনি তো তার জন্মদিন পালন করেন না। আসলে ওই সময়ে বাঙালি সমাজে জন্মদিন পালন করার রেওয়াজটা তেমন একটা চালু ছিল না। স্বাধীনতার পর ১৭ মার্চ প্রচলিত অর্থে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন পালন না করে দিনটিকে জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে পালন করা হয়। বঙ্গবন্ধু শিশুদের খুব ভালোবাসতেন, যেমনটি ভালোবাসেন তার কন্যা শেখ হাসিনা।

শেখ মুজিব হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বটে তবে তিনি বাংলাভাষীদের কাছে একজন এবং একমাত্র মহানায়ক। কারণ তিনি আজীবন বাঙালিকে শুধু মুক্তির স্বপ্নই দেখাননি, তাদের শোষক আর বিদেশি প্রভুদের হাত থেকে মুক্ত করে গেছেন, একটি পৃথক জাতিসত্তার জন্ম দিয়ে গেছেন। বাঙালির ইতিহাসে তেমনটি আর কেউ আসেনি। অমিত তেজের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের শততম জন্মবার্ষিকীতে তার স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

খুঁজলে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের অনেক বৈশিষ্ট্য হয়তো পাওয়া যাবে। কিন্তু তার দুটি বৈশিষ্ট্য তাকে অন্যদের থেকে পৃথক করেছে, যেই কারণে তিনি বাঙালির রাজনৈতিক ইতিহাসের মহানায়ক হতে পেরেছেন। প্রথমটা হচ্ছে, অন্যায় দেখলে তার প্রতিবাদ করা আর দ্বিতীয়টি সামাজিক ও অর্থনৈতিক শোষণ থেকে বাঙালিকে মুক্ত করা।

স্কুলে পড়ার সময়ই শেখ মুজিব মনে করতেন, ‘ইংরেজদের এ দেশে থাকার অধিকার নেই।’ কারণ তারা এ দেশের মানুষকে শোষণ করতে পারঙ্গম। তখন সারা ভারতবর্ষে স্বদেশি আন্দোলন চলছে। মুজিব সেই আন্দোলনে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর চরিত্র যে একগুঁয়েমি স্বভাবের ছিল, তা তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন। পেছন ফিরে তাকালে বলতে হয় তার একগুঁয়েমি স্বভাবই তাকে পূর্ব বাংলার স্বার্থে আপসহীন নেতা হতে সহায়তা করেছিল। শেখ মুজিবের প্রতিবাদী চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ তার গোপালগঞ্জে বাল্য ও কিশোর জীবনেও দেখা গিয়েছিল। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে তিনি লিখেছেন, “একদিন সন্ধ্যায় ...আমাকে খন্দকার শামসুল হক ওরফে বাসু মিয়া মোক্তার সাহেব (পরে মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন) ডেকে বললেন, ‘মালেককে হিন্দু মহাসভা সভাপতি সুরেন ব্যানার্জির বাড়িতে ধরে নিয়ে মারপিট করেছে। যদি পার একবার যাও। তোমার ওদের সাথে বন্ধুত্ব আছে বলে তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে আস।’ আমি ...ওদের ওখানে যাই এবং অনুরোধ করি ওকে ছেড়ে দিতে। রমাপদ দত্ত নামে এক ভদ্রলোক আমাকে দেখেই গাল দিয়ে বসল। আমিও তার কথার প্রতিবাদ করলাম এবং আমার দলের (শেখ মুজিবের অনুসারীদের) খবর দিতে বললাম। তিনজন পুলিশ এসে হাজির হয়ে গিয়েছে। আমি বললাম, ‘ওকে ছেড়ে দিতে হবে, না হলে কেড়ে নেব।’ ...এর মধ্যেই আমাদের সাথে মারপিট শুরু হয়ে গেছে। দুই পক্ষে ভীষণ মারপিট হয়। আমরা দরজা ভেঙে মালেককে কেড়ে নিয়ে চলে আসি।” কিশোর শেখ মুজিব গোপালগঞ্জের যে স্কুলে পড়তেন, সেখানে রেওয়াজ ছিল, মুসলমান আর নি¤œবর্ণের হিন্দুরা ক্লাসে পেছনের সিটে বসবে। এমন একটা ব্যবস্থা মানতে পারেন না মুজিব। ভাঙলেন বহুদিনের প্রথা। একদিন বসে পড়লেন সামনের বেঞ্চে। সেই চরিত্র তিনি আজীবন লালন করেছেন।

ভারতবর্ষ থেকে শোষক ইংরেজদের তাড়াতে হবে, দেশ স্বাধীন করতে হবেÑ এমন রাজনীতির সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেলেন তরুণ শেখ মুজিব। নেতা মানলেন নেতাজি সুভাষ বসু, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, এ কে ফজলুল হক, আবুল হাসিম, শরৎ বসু, আবদুস সালাম আর মোহন মিয়াকে। ১৯৪৩ সালে যোগ দিলেন মুসলিম লীগে। লক্ষ্য একটাই। ভারত থেকে ইংরেজদের তাড়াতে হবে। মনে করলেন, পাকিস্তান সৃষ্টি হলে বিশাল দরিদ্র মুসলমান জনগোষ্ঠী হিন্দু জমিদার আর মহাজনদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবে। পাকিস্তান সৃষ্টি হলে সেই ভুল ভেঙে গেল অচিরেই, যখন তিনি দেখলেন পাকিস্তান সৃষ্টির ফলে শুধু প্রভুর পরিবর্তন হয়েছে। ইংরেজ আর হিন্দু জমিদার ও মহাজনদের পরিবর্তে জায়গা দখল করেছে পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাবের পুঁজিপতি আর ধনিক শ্রেণি। যেই পাকিস্তান সৃষ্টি করার জন্য একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে রাজপথে তিনি লড়াই করেছেন আর যে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছে, তার মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাত। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী মুজিব প্রতিবাদ করবেন, তা-ই তো প্রত্যাশিত। প্রতিবাদ করতে হলে প্রয়োজন সংগঠন। ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠা করলেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ (পরে মুসলিম শব্দটি বাদ দেওয়া হয়েছিল)। ১৯৪৯ সালে তার ধারাবাহিকতায় প্রতিষ্ঠিত হলো পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ (পরে আওয়ামী লীগ)। পাকিস্তানের পরবর্তী ২৩ বছরে এই আওয়ামী লীগই বাংলা ও বাঙালির মুক্তির একমাত্র আস্থার সংগঠন ছিল। যাত্রা শুরু করেছিল মওলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর হাত ধরে। ইতিহাসের এক ক্রান্তিকালে ১৯৬৬ সালে নেতৃত্ব চলে আসে বঙ্গবন্ধুর হাতে। আওয়ামী লীগের প্রধান থেকে হয়ে উঠেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা। সত্তরের নির্বাচনের পর বাঙালি জাতির মহানায়ক।

বঙ্গবন্ধু আজীবন স্বপ্ন দেখতেন বাঙালির একটি পৃথক আবাসভূমির, যে আবাসভূমিতে বাঙালি নিজেই নিজের ভাগ্য নিয়ন্ত্রক হবে। এই স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে গিয়ে তিনি কমপক্ষে দুবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন, পাকিস্তানের ২৩ বছরে জেলে গেছেন ১৮ বার; কিন্তু কখনো আপস করেননি। বাঙালির ন্যায্য দাবি আদায় করতে গিয়ে সব সময় গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ওপর নির্ভর করেছেন, রোমান্টিক বিপ্লবী সাজার চেষ্টা করেননি। শেষে একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাঙালির একটি নিজস্ব স্বাধীন আবাসভূমি প্রতিষ্ঠা করেছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু বেঁচে ছিলেন সাড়ে তিন বছর। এই সাড়ে তিন বছরে তিনি একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে নিজের পায়ে দাঁড় করিয়ে হাঁটতে শিখিয়েছেন। দেশ যখন চলতে শুরু করেছে, তখন ঘাতকরা তাকে হত্যা করে। কারণ তারা তার স্বপ্নের সঙ্গে কখনো খাপ খাওয়াতে পারেনি এবং তারা আজীবন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীকে নিজেদের প্রভু হিসেবে দেখতে পছন্দ করত। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলেও ঘাতকরা তার স্বপ্নকে হত্যা করতে পারেনি। তার কন্যা শেখ হাসিনাই তার অসমাপ্ত কাজকে সমাপ্ত করছেন। বাংলাদেশ যখন তার জন্মের শত বছর পূর্তি উদ্যাপন করবে, তখন বিশ্ব অবাক বিস্ময়ে দেখবে ব্যক্তি মুজিবকে হত্যা করলেও তার আদর্শ বা স্বপ্নকে হত্যা করা সম্ভব হয়নি। বাঙালির রাজনীতির ইতিহাসে মহানায়ক একজনই ছিলেন তিনি বঙ্গবন্ধু। আজ তার শততম জন্মবার্ষিকী, শততম জন্মদিন। বাঙালির ইতিহাসে চিরদিন তার নাম অক্ষয় হয়ে থাকুকÑ এই প্রত্যাশা রইল।

লেখক : বিশ্লেষক ও গবেষক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close