উবায়দুল হক, ময়মনসিংহ

  ২১ মে, ২০২২

ময়মনসিংহে পুরোনো দিনের সারিন্দা প্রদর্শন

ময়মনসিংহে গায়ক ও সংগীতশিল্পীদের পুরোনো বাদনযন্ত্র সারিন্দার ওপর তিন দিনব্যাপী প্রদর্শনী শেষ হয়েছে। নগরীর কাঁচিঝুলি রোড ব্যাপ্টিস্ট চার্চ ভবনের নিচতলায় গত বুুুধবার থেকে শুরু হওয়া এ প্রদর্শনী চলে গতকাল শুক্রবার রাত পর্যন্ত। আন্তর্জাতিক জাদুঘর দিবস উপলক্ষে এ প্রদর্শনীর আয়োজন করে ‘এশিয়ান মিউজিক মিউজিয়াম’।

প্রদর্শনীতে স্থান পায় সংগ্রাহক রেজাউল করিম আসলামের সংগ্রহ করা অনেক সারিন্দা। এতে ১৭ থেকে ১৯ শতাব্দীর সারিন্দাও রয়েছে। যার মধ্যে ছিল পাটগ্রাম, বুড়িমারি, কুড়িগ্রামের রহমান ফকির থেকে পাওয়া ৩৬৫ বছরের পুরোনো সারিন্দা, লালমনিরহাটের গুনধর বাবুর কাছ থেকে পাওয়া ৩০০ বছরের পুরোনো সারিন্দা, দেবীরপাট, দুর্গাপুর, লালমনিরহাটের মনা সাধুর কাছ থেকে পাওয়া ২৫০ বছরের পুরোনো সারিন্দা। এ ছাড়া ময়মনসিংহের গৌরীপুরের নাও ভাঙার চরের মোক্তার হোসেন ফকিরের কাছ থেকে পাওয়া চার প্রজন্মের ব্যবহৃত ২০০ বছরের পুরোনো সারিন্দা। যেটি ব্যবহার করতেন মোক্তার ফকিরের বাবা রমজানী আলী ফকির। হালুয়াঘাট থেকে কীর্তিনিয়া মনীন্দ্র ওস্তাদজির ব্যবহৃত ১৫০ বছরে পুরোনো সারিন্দা রয়েছে।

এ ছাড়াও বিলুপ্ত ও চলমান ৬০০ বাদ্যযন্ত্র প্রদর্শনীতে ছিল। এ আয়োজনের সঙ্গে চলে পুঁথি পাঠ, বাউল বৈঠক, শিশুদের সংগীত ও যন্ত্রসংগীত। প্রতিদিন দুপুর ১২টা থেকে শুরু হয়ে রাত ৮টা পর্যন্ত সবার জন্য উন্মুক্ত থাকে প্রদর্শনী। এতে সহযোগিতায় রয়েছে নোভিস ফাউন্ডেশন ও ময়মনসিংহ বাউল সমিতি।

বাদ্যযন্ত্র ও লোকজ সংস্কৃতি সংগ্রাহক রেজাউল করিম আসলাম বলেন, ‘তৈরিকারক, বাদক, উপকরণ সবই হারিয়ে যাচ্ছে। একসময় সারিন্দা ছিল খুবই মূল্যবান। যারা বাজাত তারাও ছিলেন মরমি লোক। এগুলো হারানো বা নষ্ট হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য এই উদ্যোগ। এই সারিন্দা কারো রান্নাঘর, কারো গোয়ালঘর থেকে পাওয়া গেছে। যাদের কাছে পাওয়া গেছে তারা জানে না এর ঐতিহাসিক বা ঐতিহ্যগত মূল্য কত। অনেক সারিন্দা চুলার লাকড়ি বা মাটিতে মিশে শেষ হয়ে গেছে। এই প্রদর্শনী করার কারণ হলো যেন আমাদের পুরোনো সারিন্দাগুলো বিলুপ্ত না হয়। আর নতুন প্রজন্মের কাছে এই দেশীয় যন্ত্রটি নিয়ে যেন আগ্রহ তৈরি হয়।

রেজাউল করিম আসলামের সংগ্রহে রয়েছে বিলুপ্তপ্রায়, বিলুপ্ত ও চলমান প্রায় ৬০০ বাদ্যযন্ত্র। তিন পুরুষ ধরেই এই বাদ্যযন্ত্র বেচাবিক্রির সঙ্গে জড়িত আসলামের পরিবার। ময়মনসিংহ শহরের দুর্গাবাড়ী সড়কে রয়েছে ‘নবাব অ্যান্ড কোং’ নামে আসলামের একটি বাদ্যযন্ত্রের দোকান। ১৯৪৪ সালে দাদা নবাব আলী বাদ্যযন্ত্রের ব্যবসা শুরু করেন। আসলামের দাদার পর তার বাবা জালাল উদ্দিন ব্যবসার হাল ধরেন। ছোটবেলা থেকেই লোকজ বাদ্যযন্ত্রের প্রতি আগ্রহ তৈরি হয় আসলামের। পরে ২০০৬ সাল থেকে শুরু করেন বিরল বাদ্যযন্ত্র সংগ্রহ। সংগ্রহের পাশাপাশি রেজাউল করিম আসলাম এসব নিয়ে গবেষণাও করছেন। হারিয়ে যাচ্ছে যে যন্ত্রগুলো, কারিগরদের দিয়ে ওই যন্ত্রের আদলে নতুন করে আবার বাদ্যযন্ত্র তৈরি করার কাজও করছেন তিনি।

‘সারিন্দা’ সম্পর্কে বাংলাপিডিয়ায় লোকসংস্কৃতির গবেষক ওয়াকিল আহমেদ লিখেছেন, ‘সারিন্দা তত জাতীয় (তারের বাদ্যযন্ত্র) লোকবাদ্যযন্ত্র। একটি কাঠের ফ্রেম, চামড়া, সরু তার ও ছড়ের প্রধান উপকরণ। মূল কাঠামোর প্রশস্ত অংশ দুপাশে বেশ চাপা থাকে, ওপরে থাকে চামড়ার ছাউনি। এর বাকি অংশ দণ্ডাকৃতির, মাথায় থাকে পাখি বা ঘোড়া, এমনকি যেমন রাধা-কৃষ্ণের প্রতিমূর্তি খোদাই করা হয়। প্রশস্ত অংশের নিচে ফেসির সাহায্যে তিনটি তার বেঁধে চামড়ার ওপর দিয়ে টেনে কাঠামোর অপর প্রান্তে কানের সঙ্গে এঁটে বাঁধা হয়।’

এতে আরো বলা হয়, সারিন্দা বাজানো হয় ছড়ের সাহায্যে। ধনুকাকৃতির এই ছড় পশুর লেজের চুল বা রেশম সুতা দিয়ে তৈরি। সাধারণত বিচার গান, মুর্শিদি গান, নৌকাবাইচের গান, কবিগান ইত্যাদিতে অনুষঙ্গী যন্ত্র হিসেবে সারিন্দা বাজানো হয়; তবে স্বতন্ত্রভাবেও এতে গানের সুর তোলা যায়। প্রদর্শনী সম্পর্কে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন সংগ্রহশালার উপ-কীপার মুকুল দত্ত বলেন, এই ধরনের আয়োজন আরো বেশি হওয়া উচিত, তাহলে বার্তাটি সবার কাছে পেঁৗঁছালে আমাদের লোকজ সম্পদ ও লোকজ ঐতিহ্য রক্ষা পাবে।

বাউলশিল্পী আবুল কাশেম সরকার বলেন, এমন আয়োজন শিল্পী মনকে প্রফুল্ল করে। প্রদর্শনীর মাধ্যমে হারিয়ে যাওয়া বাদ্যযন্ত্রকে মানুষ নতুন করে জানতে পারবে, তরুণ প্রজন্ম পরিচিত হবে। বাউলশিল্পী সুনীল কর্মকার বলেন, সারিন্দা বাঙালির প্রাচীনতম বাদ্যযন্ত্র। এটি সংরক্ষণ করা আমাদের দায়িত্ব। আমাদের এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এসব যন্ত্র সংরক্ষণ করে রাখা খুবই জরুরি। সংরক্ষণ করে না রাখলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানবে না যে তাদের নিজস্ব একটা বাদ্যযন্ত্র ছিল। এসব যন্ত্র সম্পর্কে কেউ জানলে, তাহলে সে নিজেকে জানল এবং নিজে কিছু শেখার সুযোগ পেল।’ সারিন্দার পাশাপাশি প্রদর্শনীতে স্থান পায় সন্তর, শরৎ, সানাই, বেহেলা, তবলা, বিনা, সারেঙ্গি, সেতার, তানপুরা, একতারা, গিটার, বাঁশিসহ আরো অনেক বাদ্যযন্ত্র। আয়োজনটির সঙ্গে সমন্বয়করী হিসেবে কাজ করেছেন শিল্পী জয়িতা অর্পা ও শৈল্পিক নির্দেশনায় আছেন জাওয়াতা আফনান।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close