বিবিসি বাংলা

  ০১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

সেন্টমার্টিন ভ্রমণ

কাজে আসছে না বিধিনিষেধ

বাংলাদেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিনের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কয়েকমাস আগে পর্যটকদের যাতায়াত সীমিত করার সিদ্ধান্ত নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতিবছর ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে প্রতি রাতে গড়ে দুই হাজার করে পর্যটক থাকার অনুমতি দেওয়া হয়। আর নভেম্বর মাসে শুধু দিনেরবেলায় সেন্টমার্টিনে ঘোরার অনুমতি ছিল। রাতে এই দ্বীপে অবস্থানের সুযোগ শেষ হয় ৩১ জানুয়ারি। এরপরের ৯ মাস ভ্রমণের জন্য সেন্টমার্টিনে যাওয়া যাবে না।

অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে রাতে থাকতে পারবেন। তবে শর্ত হলো, ওই দুই মাসে দৈনিক গড়ে দুই হাজারের বেশি পর্যটক সেখানে যেতে পারবেন না। আর ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত কোনো পর্যটকই সেখানে যেতে পারবেন না। সেখানকার মানুষ ও ব্যবসায়ীরা ওই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেছেন। তারা এখনো আশা করছেন সরকার এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবে।

৩০ জানুয়ারি টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) একে আহসান উদ্দীন জানিয়েছেন, ‘ব্যবসায়ীরা এক মাস সময় বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য মানববন্ধন করছেন।’ কিন্তু সরকার শুরুতেও যেমন তার সিদ্ধান্তে অনড় ছিল, এখন পর্যন্ত তারা তাই আছে। সময় বাড়ানোর ব্যাপারে সরকার কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি।

তবে অক্টোবরে ওই সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছিলেন, ‘আমরা দ্বীপটি বাঁচাতে চাই। এটি সবার সম্পদ। পর্যটকরা দায়িত্বশীল আচরণ করলে দেশের ওই সম্পদ রক্ষা পাবে।’

সরকার তখন সেন্টমার্টিন ভ্রমণের ব্যাপারে নানা শর্তজুড়ে দেয়। যেমন- তখন বলা হয় যে সেখানে কোনো আলোকসজ্জাসহ বারবিকিউ পার্টি করা যাবে না। আট কিলোমিটার দীর্ঘ এই দ্বীপের প্রবালসহ সামুদ্রিক প্রাণী সংগ্রহ করার ওপরেও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের আদেশে বলা হয়, পর্যটকদের মাধ্যমে বা অনুমোদিত জাহাজে নিষিদ্ধ ঘোষিত পলিথিন ব্যাগ ও একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক পরিবহন করা যাবে না। পর্যটকরা কোনো হোটেলে অবস্থান করবেন তার রেজিস্টার সংরক্ষণ করতে হবে। বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের অ্যাপ থেকে সংগ্রহ করা ট্রাভেল পাসধারী পর্যটকদের অনুমোদিত জাহাজে ভ্রমণ নিশ্চিত করতে হবে।

তবে আইইউসিএন বাংলাদেশের মুখ্য গবেষক সীমান্ত দীপুও বলেন, ‘যেভাবে বলা হয়েছিল, সেভাবে ট্রাভেল পাস ব্যবহার হচ্ছে না। তবে মানুষ কম যাচ্ছে, এটি সত্য।

সম্প্রতি ঢাকা থেকে সেন্টমার্টিনে সপরিবারে ঘুরতে গিয়েছিলেন জাকিয়া আহমেদ। তিনি বলেন, জাহাজে অনেক ভোগান্তি। স্ট্যান্ডিং টিকিট নিয়েও অনেকে এবার সেন্টমার্টিনে গেছেন। পর্যটন সীমিতকরণে সরকারের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানো। কিন্তু বিচের কোথাও কোনো বিন নেই। বিন না থাকায় পুরো বিচজুড়ে চিপস-বিস্কুটের প্যাকেট, বোতল, সিগারেটের প্যাকেট পড়ে থাকে।’

সেন্টমার্টিনে যারাই যান, তারা সাধারণত বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণে অবস্থিত ভূখণ্ড ছেঁড়াদ্বীপও ঘুরে আসতে চান। যদিও ভ্রমণের উদ্দেশে যেখানে যাওয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আছে। এই নিষেধাজ্ঞারও কোনো বাস্তবায়ন নেই।

‘আমি নিজে সেখানে যাইনি। কিন্তু আমি যে রিসোর্টে ছিলাম, সেখানেরই অনেকে সূর্যোদয় দেখতে ছেঁড়াদ্বীপে গিয়েছেন। তারা কোস্টগার্ডের চোখ ফাঁকি দেওয়ার জন্য ভোররাতে চারটার দিকে রিসোর্ট থেকেই অটো করে যান। আবার সাতটার দিকে ফিরে আসেন।’ সেইসঙ্গে আলোকসজ্জা থেকে শুরু করে বারবিকিউ পার্টি, সবই চলছে। বলেন তিনি।

একই কথা বলছেন সাম্প্রতিক সময়ে সেন্টমার্টিন ঘুরে আসা সাদিয়া আফরিন। তিনি বলেন, ‘দ্বীপে, মানে বাইরে সৈকতে বারবিকিউ করে না। তবে রিসোর্টে করা যায়।’

২০১৭ সাল থেকে ট্যুর অপারেটর হিসেবে কাজ করছেন জান্নাতুল ফেরদৌসী। প্রতিবছর তিনি দেশের বিভিন্ন জায়গায় পর্যটকদের নিয়ে ভ্রমণে বের হন। এবার তিনি গিয়েছিলেন সেন্টমার্টিনে। তার ভাষ্য, ‘এর আগেও আমি এখানে এসেছি। কিন্তু এবারের মতো এরকম বাজে অভিজ্ঞতা কখনো হয়নি। এখানে আগেও অনেক অনিয়ম হতো। কিন্তু নিষেধাজ্ঞায় আলাদা করে কিছু পরিবর্তন হয়নি। বরং, অনিয়ম যেন আরো বেশি হচ্ছে এখন।’

আর একসঙ্গে অনেক দর্শনার্থী যাওয়ার কারণে নোংরাও বেশি হচ্ছে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, ‘প্লাস্টিক নিষিদ্ধ। সেজন্য শিপে জার থেকে পানি নিয়ে খেতে হয়। অথচ সেন্টমার্টিন গিয়ে দেখবেন বোতল আর বোতল, পানিতে ভাসছে।’

পর্যটকদের মূল অভিযোগ প্লাস্টিকের ব্যবহার নিয়ে। সেন্টমার্টিনের একটি রিসোর্টের মালিক আবদুল্লাহিল মামুন নিলয় বলেন, ‘এখানে সমস্যা হলো, বাধ্যবাধকতা নাই।’

‘সরকার যদি বাধ্যতামূলকভাবে বলতো যে রিসোর্টগুলোর সামনে প্লাস্টিক থাকতে পারবে না, তাহলে ছোট রিসোর্টগুলোতেও একজন লোক রাখা হতো শুধু এই জিনিস পরিষ্কারের জন্য।’

আইইউসিএন বাংলাদেশের মুখ্য গবেষক সীমান্ত দীপু বলেন, ‘এখানে ডিক্ল্যারেশন আছে, কিন্তু মনিটরিং নাই এটা সত্য। তবে সব দায়িত্ব সরকারের একারও না।’

তার মতে, মানুষ কম গেলে প্লাস্টিকের ব্যবহার এমনিতেই কমে যাবে। সরকার যদি তার নজরদারি নাও বাড়ায়, তবুও আস্তে আস্তে প্লাস্টিক কমবে।’

পর্যটক কমে গেলে আর্থিক ক্ষতি হলেও পরিবেশের উপকার হবে জানিয়ে তিনি আরো বলেন, ‘সেখানে মানুষ ও জাহাজ না গেলে কচ্ছপ ও কোরালের প্রজনন ভালো হবে।

সেইসঙ্গে, অতিথি পাখির সংখ্যাও ধীরে ধীরে বাড়বে।’

‘মানুষ বেশি গেলে জেলেরা প্রচুর কোরাল তুলে আনে ও পর্যটকদের কাছে সেগুলো বিক্রি করে। পর্যটক কম গেলে তো ওরা আর আগের মতো কোরাল ধরবে না। সুতরাং এতে লাভটাই বেশি।’

সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. মুজিবুর রহমান বলেন, ‘জানুয়ারিতেই বন্ধ করে দিলে ব্যবসায়ীদের ক্ষতি হবে।’ তারা চার মাসের জায়গায় দুই মাস ব্যবসা করতে পারছে-জানিয়ে তিনি আরো বলেন, ঠিকভাবে তত্ত্বাবধায়ন করলে দুই মাস আর চার মাস চলার মাঝে খুব একটা ফারাক নেই।

টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) একে আহসান উদ্দীন বলেন, প্লাস্টিকের ব্যবহার সীমিত করার বিষয়ে পর্যটকদেরও দায় আছে। তারা যেখানে-সেখানে প্লাস্টিক ফেলে রেখে যান। যদি সরকারের সিদ্ধান্ত না পরিবর্তন হয়, তাহলে ফেব্রুয়ারি থেকে আমাদের পরবর্তী কাজ হবে তাদের সেই ফেলে যাওয়া প্লাস্টিক-পলিথিনগুলো পরিষ্কার করা। এবার সেন্টমার্টিনে কোনো নাইট পার্টি ছিল না। উচ্চস্বরে সাউন্ড বাজানোয় নিষেধাজ্ঞা ছিল। ছেঁড়াদ্বীপে যাওয়া নিয়ন্ত্রণ করেছি আমরা।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close