মো. ইসমাইল হোসেন, মানিকছড়ি (খাগড়াছড়ি)
দোছড়িপাড়া বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়
জরাজীর্ণ শ্রেণিকক্ষেই চলে শিক্ষাকার্যক্রম

খাগড়াছড়ির মানিকছড়ির দুর্গম এলাকার একটি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নেই দরজা-জানালা ও নিরাপত্তাবেষ্টনী। খুলে পড়ছে বাঁশ-কাঠের তৈরি চারপাশের কোনো না কোনো অংশ। বিদ্যালয়টিতে শুকনো মৌসুমে প্রবেশ করে ধুলাবালু আর বর্ষা মৌসুমে বেষ্টনী না থাকায় বৃষ্টির ঝাপটা, ঝড় বা ঝোড়ো হাওয়ায় পাঠদান দুষ্কর হয়ে পড়ে। বৃষ্টি এলে পানি পড়ে শ্রেণিকক্ষে। গ্রামীণ কাঁচা সড়কের পাশে স্থাপিত এমন পরিবেশেই রোদণ্ডবৃষ্টি-শীত উপেক্ষা করে চলছে শ্রেণিকক্ষের শিক্ষা কার্যক্রম। এতে মন বসছে না শিক্ষার্থীদের। এমনই এক পরিবেশে চলছে খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি উপজেলাধীন দোছড়িপাড়া বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কার্যক্রম।
সরেজমিনে দেখা যায়, মানিকছড়ি উপজেলার শতাধিক পরিবারে প্রতিবছর বেড়ে ওঠা কোমলমতি শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে সেখানকার এক প্রাইমারি শিক্ষক, কারবারি ও স্থানীয়দের উদ্যোগে ২০১৬ সালে স্থাপন করা হয় ‘দোছড়িপাড়া বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’। মাত্র চারজন শিক্ষার্থী নিয়ে শুরু করা বিদ্যালয়টিতে এখন শিক্ষার্থীর সংখ্যা ষাট। তবে নতুন বছরে আরো বাড়বে। কর্মরত আছেন পাঁচজন শিক্ষক।
অভিভাবক ও স্থানীয়দের সহায়তায় নামমাত্র সম্মানিতেই চালিয়ে নিচ্ছেন শিক্ষা কার্যক্রম। তবে বর্তমানে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়া খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। কেননা, স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগারের পাশাপাশি নেই ন্যূনতম মানের শ্রেণিকক্ষ। একটি কক্ষে চলছে দুটি শ্রেণির কার্যক্রম। নেই পর্যাপ্ত চেয়ার-টেবিল ও বেঞ্চের ব্যবস্থা। শিক্ষার উপযোগী যে পরিবেশটুকু দরকার তার ছিটেফোঁটাও নেই এ বিদ্যালয়ে। তারপরও চলছে কার্যক্রম, কেননা আড়াই থেকে ৪ কিলোমিটারের মধ্যে নেই কোনো সরকারি-বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। তাই নানা ঝুঁকিতেও বিদ্যালয়ে আসছে শিক্ষার্থীরা।
৫ম শ্রেণি পড়ুয়া শিক্ষার্থী খুশি চাকমা, অর্জিত চাকমা, রুপান্ত চাকমা বলে, বৃষ্টি এলে তাদের গায়ে পানি পড়ে, জামাকাপড়সহ বইখাতা ভিজে যায়। দরজা-জানালা ভাঙা ঘরে তাদের পড়াশোনায় মন বসে না। চতুর্থ শ্রেণির আদর্শি চাকমা, রাজশ্রী চাকমা ও পরমি চাকমা বলে, ক্লাস চলছে, এমন সময় খুলে পড়ছে শ্রেণিকক্ষের বেষ্টনী ও উপরের অংশ। সরকারি বিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মতো পাকা ভবনে পড়ার স্বপ্ন দেখেন তারা।
দূরবর্তী শিক্ষার্থী রতন বিকাশ চাকমা, সাধী কুমার চাকমা, সুবধন চাকমা জানায়, কাঁচা রাস্তায় হেঁটে স্কুলে আসতে অনেক কষ্ট হয়। বৃষ্টি হলে নিয়মিত আসা যায় না। তার মধ্যে স্কুলের পরিবেশও খারাপ, এতে তাদের মন বসে না।
একাধিক অভিভাবক জানিয়েছেন, এখানকার অধিকাংশ পরিবারের লোকজন খেটে খাওয়া ও অসচ্ছল। তাদের পক্ষে উপজেলা সদরের উন্নত স্কুলে সন্তানের পড়াশোনা করানো সম্ভব না। তাই বিদ্যালয়েল পরিবেশ ও পড়াশোনা যেমনি হোক এটিই তাদের ভরসা। তাই সংশ্লিষ্ট দপ্তরের প্রতি অবকাঠামো উন্নয়নসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন তারা।
কর্মরত সহকারী শিক্ষকরা জানান, নামমাত্র বেতনে শিক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া হয়। নতুনা দুর্গম এ জনপদে বেড়ে ওঠা বহু শিশু-কিশোর শিক্ষার আলো থেকে পিছিয়ে পড়ে নিরক্ষর থেকে যাবে। তবে যেদিন বিদ্যালয়টি জাতীয়করণ হবে, সেদিন তাদের সুদিন ফিরবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তারা।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হেমন্ত চাকমা জানান, দুর্গম এলাকার কোমলমতি শিক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করে কাজ করে যাচ্ছি। তেমন বেতন-ভাতাও পাচ্ছি না। তবে বিদ্যালয়টি জাতীয়করণ করা হলে অন্য সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মতো সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যাবে। তাই বিদ্যালয়টি জাতীয়করণ করারও দাবি জানান তিনি।
বিদ্যালয়ের সভাপতি দেবরণ চাকমা জানান, দীর্ঘদিন ধরে অবকাঠামো উন্নয়নসহ নানা সমস্যার মধ্যে চলছে কার্যক্রম। কিন্তু বর্তমানে বিদ্যালয়টির জরাজীর্ণ শ্রেণিকক্ষে পাঠদান কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়া খুবই মুশকিল। তাই বিদ্যালয়ের একটি পাকা ভবন ও মানসম্মত শৌচাগার খুবই প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন তিনি।
উপজেলা শিক্ষা অফিসার তপন কুমার চৌধুরী বলেন, উপজেলার বেশ কয়েকটি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবকাঠানো উন্নয়নসহ জাতীয়করণ লক্ষ্যে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে। আশা করছি জাতীয়করণ কার্যক্রম চালু হলে অত্র বিদ্যালয়টিও সরকারিকরণ করা হবে।
বিদ্যালয়ের অবকাঠানো উন্নয়ন ও শিক্ষা উপকরণ বিতরণসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার তাহমিনা আফরোজ ভূঁইয়া।
"