ইবি প্রতিনিধি

  ০৭ ডিসেম্বর, ২০২৪

ইবি ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজে বছরে অপচয় কোটি টাকা

* প্রয়োজনের তুলনায় শিক্ষক-শিক্ষার্থী নেই * এইচএসসিতে ১৪ জন পরীক্ষা দিয়ে পাস তিনজন * সাত কোটিতে নির্মিত নতুন ভবন খালি থাকবে

১৯৯৬ সালে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সন্তানদের পড়াশোনার জন্য প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ইবি ল্যাবরেটরি স্কুল। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এর পেছনে বিশবিদ্যালয় প্রশাসন প্রতিবছর মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করতে প্রতিবছর প্রায় এক কোটি ৩০ লাখ টাকা ব্যয় হচ্ছে। ব্যয়ের পরিমাণ বছরপ্রতি ৫% করে বৃদ্ধি পায়। এর মধ্যে ইউজিসি থেকে মাত্র ২০ লাখ টাকা দেওয়া হয়। বাকি এক কোটি ১০ লাখ টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন খাত থেকে অনুদান দেয়া হচ্ছে। মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করলেও দিনশেষে উপর্যুক্ত ফলাফল দিতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিষ্ঠানটির মান, শিক্ষকদের দক্ষতা ও অ্যাকাডেমিক সিডিউল নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন। এর কারণে এতে ভর্তি হচ্ছে না মেধাবী শিক্ষার্থীরা। এমনকি কমছে প্রয়োজনের তুলনায় শিক্ষার্থীর সংখ্যাও। লক্ষ্যচ্যুত হয়ে বহিরাগত শিক্ষার্থীদের গণহারে ভর্তি করতে বাধ্য হচ্ছে স্কুল কর্তৃপক্ষ।

এদিকে এমন দুর্দশার মধ্যে ২০২০ সালে প্রতিষ্ঠানটিতে কলেজ পর্যায়ের কোনো শিক্ষক ছাড়াই কলেজ শাখা চালু করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুনুর রশীদ আশকারী। যা প্রতিষ্ঠানটির সংকটকে আরো দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেয়। স্কুল পর্যায়ের শিক্ষকরাই পরিচালনা করছে কলেজের শ্রেণি কার্যক্রম। ফলে বিভিন্ন পরীক্ষার ফলাফলে নেমে এসেছে ধস। এ বছরের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ১৪ জন পরীক্ষা দিয়ে পাস করেছে মাত্র তিনজন। এর আগের বছর ১১ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র ছয়জন উত্তীর্ণ হন। অন্যদিকে মাধ্যমিকেও বিগত চার বছরে শতভাগ পাস করার রেকর্ড নেই। এর পেছনে মোটা অঙ্কের টাকা খরচকে ভস্মে ঘি ঢালার সঙ্গে তুলনা করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক অ্যাডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ (আইআইইআর) এর দ্বারা পরিচালিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই প্রতিষ্ঠানটির দৈন্যদশা শুরু হয়েছে। প্রয়োজনের তুলনায় পর্যাপ্ত শিক্ষার্থী খুঁজে পাচ্ছে না প্রতিষ্ঠানটি। ৫৫০ জন শিক্ষার্থী থাকার কথা থাকলেও বর্তমানে এতে ৩৫০ জন শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত রয়েছেন। এদের মধ্যে প্রাথমিক পর্যায়ে মাত্র ৫০ জন এবং একাদশ শ্রেণিতে ১৫০ জন শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত থাকার কথা থাকলেও রয়েছে মাত্র ২০ জন। শিক্ষার্থী সংকট ও ফলাফলে ধসের কারণে আগামীতে কলেজ শাখায় নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি নেবে না কর্তৃপক্ষ। ফলে সম্প্রতি সাত কোটি ৪২ লাখ টাকা বাজেটে নির্মিত নতুন ভবনের অনেক রুম খালি পড়ে থাকবে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সন্তানদের জন্য প্রতিষ্ঠা করা হলেও প্রতিষ্ঠানটিতে পড়ছেন বহিরাগত শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক হাজার ২০০ শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সন্তানদের মাত্র ৭-১০% এতে পড়ছেন। শিক্ষার্থী সংকটে জর্জরিত হওয়ার পামশাপাশি এতে রয়েছে শিক্ষক সংকটও। এই ৩৫০ শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক রয়েছে মাত্র ১২ জন। এর মধ্যে ২ জন ছুটিতে রয়েছেন। এই স্বল্পসংখ্যক শিক্ষক দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না বলে বরারবই অভিযোগ করেছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তাদের অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের একটি প্রতিষ্ঠানের এমন দুরবস্থার পেছনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের গাফিলতি ও প্রতিষ্ঠানটির অদক্ষ শিক্ষকরাই দায়ি। বিগত প্রশাসনগুলো যোগ্যতা ছাড়াই তাদের পছন্দসই লোকদেরই এখানে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। যার কারণে দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষক পায়নি প্রতিষ্ঠানটি। এতে প্রতি বছরই পরীক্ষার ফলাফলের এমন দুরবস্থা দেখা যাচ্ছে। তাই বাধ্য হয়ে অনেক শিক্ষক-কর্মকর্তা ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করে ক্যাম্পাসের বাইরে পড়ান। এ ছাড়া বাইরের শিক্ষার্থীরাও এখানে ভর্তি হতে চায় না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক বলেন, স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সহায়ক হিসেবে। যেখানে শিক্ষক-কর্মকর্তাদের সন্তানরা পড়বে। এখন উল্টো প্রতিষ্ঠানটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। না পারা যাচ্ছে ছেড়ে দিতে না পারা যাচ্ছে চালাতে। এর পেছনে যে টাকা ব্যয় হয় আর যা ফল হয় এতে পানিতে টাকা ফেলা বললেও ভুল হবে না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. জালাল উদ্দিন বলেন, দেশের অন্য প্রতিষ্ঠানে যেভাবে জিপিএ ৫ এর ছড়াছড়ি সেখানে এই প্রতিষ্ঠানকে পাস নিয়ে টানাটানি করতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিেিত সেখানে শিক্ষকরা তাদের সন্তানদের পড়াতে আগ্রহী হবে না এটাই স্বাভাবিক বিষয়। এ ছাড়াও এখানকার শিক্ষকদের দক্ষতা ও যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।

তবে স্কুল কর্তৃপক্ষের দাবি, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী ক্যাম্পাসে না থাকায় মেধাবী শিক্ষার্থী পাচ্ছে না প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান শিক্ষক মোজাম্মেল হক বলেন, উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষক ও অন্য সুবিধা ছাড়াই তৎকালীন প্রশাসন কলেজ শাখা চালু করেছে। তখন থেকেই আমরা মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের দিয়ে কলেজ শাখা পরিচালনা করছি। যেটি একটি অসম্ভব কাজ। শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, এখানে ২০১০ সালে পরে কোনো শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়নি। তাদের অভিযোগ ভিত্তিহীন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের আইআইইআরের পরিচালক অধ্যাপক ড. ইকবাল হোসেন বলেন, যেখানে শুধুমাত্র স্কুল পর্যায়ের জন্য ২০ জন শিক্ষক প্রয়োজন সেখানে কলেজ ও স্কুল মিলিয়ে মাত্র ১১ জন শিক্ষক। আমার বলতে দ্বিধা নেই যে বিগত প্রশাসনগুলো যোগ্যতা ছাড়াই তাদের পছন্দসই লোকদেরকেই শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নকীব মোহাম্মদ নসরুল্লাহ বলেন, প্রতিষ্ঠানটির ভালো অবস্থায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করব। শিক্ষকরা ক্যাম্পাসে না থাকায় ও বিগত সময়ে ভালো শিক্ষক নিয়োগ না দেওয়ায় এটির এমন অবস্থা। তাছাড়া ফলাফল ভালো না হওয়ার ফলে আশপাশের মেধাবীরাও এখানে ভর্তি হতে অনাগ্রহী। এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বোঝা হয়ে দাঁয়িয়েছে। এটি সংস্কারে কাজ শুরু করে দিয়েছি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close