প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক

  ৩০ নভেম্বর, ২০২৪

শীতের শুরুতেই খেজুরের রস সংগ্রহে ব্যস্ত গাছিরা

পৌষ মাঘ শীতকাল হলেও হিমেল পরশ পাওয়া যায় আশ্বিন কার্তিক থেকে। আর অগ্রহায়নে মোটামুটি ভালোই শীত পড়ে। উত্তরের হিমেল হাওয়ার বার্তার পাশাপাশি শীতকাল বাঙলার ষড়ঋতুর মধ্যে আলাদা ঐতিহ্য বয়ে আনে। কারণ অগ্রহায়নে ও পৌষে নতুন ধান ওঠে চাষির ঘরে, আর এই সময়ে পাওয়া যায় খেজুরের রস। আর এই দুইয়ে মিলে কৃষকের ঘরে ঘরে চলে নবান্নের উৎসব। এবার মধ্য অগ্রহায়নে মাত্র শীত জেকে বসতে শুরু করেছে। আর খেজুর গাছের রস সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন গাছিরা। তারা খেজুর গাছের ওপরের ডালপালা কেটে পরিস্কার করে, তারপর সেই অংশ চেছে নানা প্রক্রিয়ায় রস বের করেন। বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-

সিরাজগঞ্জ : সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশে খেজুর রস সংগ্রহের জন্য গাছ প্রস্তুত করতে ব্যস্ত সময় পার করছেন গাছিরা। উপজেলা বারুহাস ইউনিয়নের রানীদিঘী গ্রামের গাছি হাছেন আলী রস সংগ্রহের প্রক্রিয়া সম্পর্কে বলেন, সাধারণত কার্তিক মাসে খেজুর গাছ প্রস্তুত করতে হয়। একটা গাছকে ডাল পালা কেটে প্রস্তুত করতে কয়েকদিন সময় লাগে। রস সংগ্রহের জন্য সাধারণত মাটির হাড়ি ব্যবহার করা হয়। রসকে ভালো রাখার জন্য হাড়ির ভিতরে চুনের প্রলেপ দেওয়া হয়। তবে যে গাছের কাঁচা রস খাওয়া হয়, সে গাছের হাড়িতে চুন দেওয়া হয় না।

তিনি আরও বলেন, একটা গাছ থেকে দুই-তিন মাস রস পাওয়া যায়। গাছ ভেদে প্রতিদিন ১ থেকে ১০ কেজি পর্যন্ত রস পাওয়া যায়। প্রথম ৩ দিন রস সংগ্রহের পর পরবর্তী ৩ দিন বিরতি দিতে হয়।

খেজুর রস সংগ্রহকারী অপর গাছি জাহিদুল জানান, একেকজন ২০ থেকে ৩০টির মতো গাছ থেকে রস করে। এর মধ্যে দুই একজনের নিজের কিছু গাছ থাকলেও বাকি সবারই অন্যের গাছ থেকে রস সংগ্রহ করতে হয়। প্রতিটি গাছের জন্য গাছের মালিককে দিতে হবে ৭/৮ কেজি নলেন গুড় অথবা ১ হাজার করে টাকা।

তাড়াশ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, খেজুর গাছের জন্য বাড়তি পরিচর্যার প্রয়োজন হয় না। বাড়ির আশপাশ, জমির আইল, পুকুরপাড় এবং সড়কের ধারে খেজুর গাছ লাগানো যায়। পরিত্যক্ত জমিতে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে খেজুর বাগান গড়ে তোলা সম্ভব বলে জানান তিনি।

অভয়নগর (যশোর) : যশোরের অভয়নগরে খেজুর গাছ কাটার প্রতিযোগিতা পড়েছে গাছিদের মধ্যে। অনেকে বলেন মধুবৃক্ষ। মৌসুম শুরু হতে না হতেই গাছিরা দড়ি, দা, ঠুঙ্গি সহ প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে গাছ কাটায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। গাছি দা দিয়ে খেজুর গাছের মাথার সোনালি অংশ বের করেন। যশোর অঞ্চলে একে বলা হয় ‘গাছ তোলা’।

উপজেলার বাগদা গ্রামের হাসান ফকির বলেন, দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে খেজুরের রস সংগ্রহ করি। যশোরের খেজুরের রস খুব নাম করা। শহর থেকে আমার রস ও গুড় কিনতে অনেকে ছুটে আসেন। সিদ্ধিপাশা গ্রামের নজরুল ঢালী বলেন, গত বছর আমি ৩০০ খেজুরের গাছ কেটেছিলাম। এই বছর আরো বেশি গাছ কাটবো। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোছা. লাভলী খাতুন বলেন, অভয়নগর উপজেলায় ৩৩ হাজার রস আহরণ কারি খেজুরের গাছ রয়েছে। যা থেকে প্রায় ৪০০ মেট্রিক টন গুড় উৎপাদন হবে।

নাচোল (চাঁপাইনবাবগঞ্জ) : চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল বরেন্দ্র অঞ্চলে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে মধুবৃক্ষ খেজুরের গাছ। অগ্রহায়ণ, পৌষ ও মাঘ মাস রসের মাস হলেও রস আহরণে গাছ তৈরি করার ধুম পড়ে না এসময় গাছিদের। পেশা ছেড়েছেন অনেক গাছি সম্প্রদায়, আজ নানা কারণে খেজুর গাছ নিধন ও চারা না রোপণ করায় নাচোলের বরেন্দ্রভূমিতে কমছে খেজুরের গাছ। বর্তমানে দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে খেজুরের রস।

আখিলা গ্রামের হযরত আলী বলেন, মাঠের মধ্যে অনেক খেজুরের গাছ দেখেছি, খোলা ক্ষেতের মাঠে গরু -ছাগল ছেড়ে দিয়ে খেজুরের গাছের ছায়ায় নিচে শুয়ে পড়েছি, বসে থেকেছি। ছোটবেলায় পুকুরের পাড়, খাড়ির ধার, কবরের পাশে খেজুর গাছের ডাল লাগাতে দেখেছি, অযত্নে অবহেলায় কোনো পরিচর্যা ছাড়াই বড় হতে দেখেছি, ওই গাছগুলো ছোট ছোট খেজুর লবণ পানিতে সারারাত ভিজিয়ে সকালবেলায় খেতাম। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হয়তো চিনবেই না।

সাংবাদিক মনিরুল ইসলাম বলেন, আমাদের নাচোল উপজেলায় গাছি নেই বললেই চলে, বিভিন্ন কাজে মানুষ মনোযোগী হলেও গাছ রোপণ বা এই শিল্পে নতুন করে কেউ এগিয়ে আসে না। খেজুর গাছ দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপে¬ক্সের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা ডাক্তার আসাদুর রহমান বিপ¬ব বলেন, খেজুর গাছের রস পুষ্টিকর। তবে নিপা ভাইরাস নিয়ে সতর্কতার সঙ্গে রস সংগ্রহ করা দরকার।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সালেহ্ আকরাম বলেন, খেজুর গাছ একটি অর্থকারী গাছ। তালের গাছের মত খেজুরের গাছও বজ্রপাত নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। খেজুর গাছ না থাকায় ভিন্ন পেশায় চলে গেছেন গাছি সম্প্রদায়রা। এই কর্মকর্তা আরো বলেন, সদর ইউনিয়নের ভেরেন্ডী ও নিজামপুর ইউনিয়নের কেন্দুয়া ঘাসুড়াতে বিদেশি খেজুরের দুইজন উদ্যোক্তা আছেন।তারা খেজুর চাষে লাভবান হচ্ছেন। তিনি আরো জানান, এই বরেন্দ্রভূমিতে বাণিজ্যিকভাবে দেশি খেজুর গাছ লাগানোর জন্য উদ্যোক্তা নেই। কেউ যদি সরকারি নার্সারি থেকে দেশি খেজুরের চারা কিংবা বীজ নিতে চায়, তাকে বিনামূল্যে সরবরাহ করা হবে।

কলারোয়া (সাতক্ষীরা) : সাতক্ষীরার কলারোয়ায় মধ্য হেমন্তে উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের গাছিরা খেজুর গাছ পরিচর্যা করার জন্য ব্যস্ত সময় পার করছেন। উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ইতোমধ্যে রস সংগ্রহের লক্ষ্যে খেজুর গাছ প্রস্তুত করতে দেখা গেছে।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শুভ্রাংশ শেখর দাস জানান, উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে আগাম খেজুর রস আহরণ করা হয়। প্রতি বছর খোরদো হাটকে গুড়-পাটালির শ্রেষ্ঠ হাট হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close