বিবিসি বাংলা

  ০৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

যেসব পরিবর্তন শুরু

নতুন এ সরকারের হাতে গত এক মাসে প্রশাসনের শীর্ষ পদে ব্যাপক রদবদলের ঘটনা ঘটেছে, যা এখনো চলমান।

পুলিশের থানায় ফেরা : গত ৫ আগস্ট বিভিন্ন এলাকার বহু থানায় নজিরবিহীন হামলার ঘটনা ঘটে। ওই সময় সারা দেশের ৬৩৯টি থানার মধ্যে অন্তত ৪৫০টি আক্রান্ত হয়েছিল বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন। ভাঙচুর করে থানা জ্বালিয়ে দেওয়া, অস্ত্র ও মালামাল লুট, এমনকি পুলিশ হত্যার ঘটনাও তখন ঘটতে দেখা গেছে। সরকার পতনের আগে-পরে সহিংসতায় সারা দেশে পুলিশের কমপক্ষে ৪৪ জন সদস্য নিহত হন বলে জানান কর্মকর্তারা।

এমন পরিস্থিতিতে কর্মস্থলে নিরাপত্তা, পুলিশ হত্যার বিচার, ক্ষতিপূরণসহ বেশকিছু দাবিতে কর্মবিরতি শুরু করেন পুলিশ সদস্যরা। এতে চুরি-ডাকাতির ঘটনা বেড়ে যাওয়াসহ দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতে ব্যাপক অবনতি ঘটে। একপর্যায়ে, স্থানীয় বাসিন্দা ও স্বেচ্ছাসেবীরা রাত জেগে পাড়া-মহল্লায় পাহারা দেওয়া শুরু করেন। সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর সারা দেশে ভেঙে পড়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নেন। তৎকালীন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত বিগ্রেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন বেশ কয়েক দফা বৈঠকের পর পুলিশের দাবি পূরণের আশ্বাস দেন। সেই সঙ্গে, কর্মস্থলে যোগ দেওয়ার সময়সীমা বেঁধে দিয়ে বলেন, ১৫ আগস্টের মধ্যে কাজে যোগ না দিলে তিনি চাকরি করতে ইচ্ছুক নন বলে ধরে নেওয়া হবে।

এ অবস্থায় ১১ আগস্ট কর্মবিরতি প্রত্যাহার করে থানায় ফেরেন পুলিশ সদস্যরা।

প্রশাসনে ব্যাপক রদবদল : গত এক মাসে প্রশাসনিক বিভিন্ন পদে ব্যাপক রদবদল হতে দেখা গেছে। স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসন, স্থানীয় সরকারসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে নতুন করে বদলি, পদায়ন ও নিয়োগ করা হয়েছে কয়েকশ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে। অনেকেই হয়েছেন বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাও (ওএসডি)। বেশ কয়েকজনকে বাধ্যতামূলক অবসরেও পাঠানো হয়েছে। আওয়ামী লীগ আমলে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যে এরই মধ্যে বাদ পড়েছেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের দায়িত্বে থাকা তোফাজ্জল হোসেন মিয়া এবং পররাষ্ট্র সচিবের দায়িত্ব পালন করা মাসুদ বিন মোমেন। একইভাবে, চাকরি হারিয়েছেন অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকা আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম। তার জায়গায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব মো. আবদুর রহমান খান।

এর আগে, গত ৬ আগস্ট চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের চুক্তি বাতিল করে নতুন পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) করা হয় অতিরিক্ত আইজিপির দায়িত্বে থাকা মো. ময়নুল ইসলামকে।

বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়েছে আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মো. মনিরুজ্জামানসহ আরো অনেক কর্মকর্তাকে।

অন্যদিকে, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মোস্তফা কামাল, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরীসহ আরো বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়েছে।

প্রশাসনিক গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে যাদের সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তারা শেখ হাসিনা সরকারের অনুগত ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তাদের জায়গায় আগের কোণঠাসা বা বঞ্চনার শিকার কর্মকর্তারা প্রাধান্য পাচ্ছেন বলে জানা যাচ্ছে।

ড. ইউনূস ও খালেদা জিয়ার সাজা বাতিল : সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে গেছে অনেক মামলার রায়। আওয়ামী লীগ শাসনামলে শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলায় ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক নূরজাহান বেগমকে।

কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেওয়ার আগের দিন তাদের দুজনেরই সাজা বাতিল করে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

একইভাবে তারা দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা অর্থ আত্মসাতের মামলা থেকেও সম্প্রতি খালাস পেয়েছেন। যদিও শুরু থেকেই অধ্যাপক ইউনূস বলে আসছিলেন যে, ‘হয়রানি’ করার জন্যই ভিত্তিহীন মামলায় তাদের ফাঁসানো হয়।

অন্যদিকে, শেখ হাসিনার আমলে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় সাত বছরের জেল দেওয়া হয়েছিল বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে। কিন্তু সরকার পতনের একদিন পরেই রাষ্ট্রপতি তার সাজা মওকুফ করে মুক্তি দেওয়ার নির্দেশ দেন।

এ ছাড়া মানহানির অভিযোগে দায়ের করা পাঁচটি মামলা থেকেও খালাস পেয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন। মামলাগুলো মিথ্যা ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিল বলে অভিযোগ করে আসছিল বিএনপি। এর বাইরে, মুক্তি দেওয়া হয়েছে কোটা ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চলাকালে গ্রেপ্তার শিক্ষার্থীদের।

শেখ হাসিনাসহ প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে মামলা : দুর্নীতি, হত্যা, মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ নানান অভিযোগ থাকার পরও গত দেড় দশকে যাদের বিরুদ্ধে সেভাবে আইনি ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি, আগের সরকারের সেসব প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে এখন মামলা হতে দেখা যাচ্ছে।

এরই মধ্যে শতাধিক মামলায় আসামি করা হয়েছে শেখ হাসিনাকে, যেগুলোর বেশির ভাগই হত্যা মামলা। একইভাবে আসামি হয়েছেন সজীব ওয়াজেদ, সায়মা ওয়াজেদ, শেখ রেহানাসহ আওয়ামী লীগ সভাপতির পরিবার ও নিকট আত্মীয়দের অনেকে। সেই সঙ্গে, সাবেক মন্ত্রী-এমপিসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের প্রায় সব নেতার বিরুদ্ধে মামলা হতে দেখা গেছে।

গুমের ঘটনা তদন্তে কমিশন : আওয়ামী লীগ আমলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেওয়া বা গুম হওয়া ব্যক্তিদের অনেকেরই খোঁজ মিলছে সরকার পরিবর্তনের পর। আগের সরকারের নির্দেশেই বিভিন্ন গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্যরা তাদের তুলে নিয়ে বছরের পর বছর আটকে রেখেছিলেন বলে ভুক্তভোগীদের বর্ণনায় জানা যাচ্ছে। তেমনই একজন জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির প্রয়াত গোলাম আজমের ছেলে সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহিল আমান আযমী। পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে নিখোঁজ থাকার পর মুক্তি পেয়েছেন বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম কেন্দ্রিক একটি রাজনৈতিক দল ‘ইউপিডিএফ’র সংগঠক মাইকেল চাকমা। সেই ‘আয়না ঘর’ থেকে আরো মুক্তি পেয়েছেন জামায়াত নেতা মীর কাশেম আলীর ছেলে আহমেদ বিন কাশেম আরমান।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান : দুর্নীতির অভিযোগে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রায় অর্ধশত মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। একই অভিযোগে তদন্ত হচ্ছে কয়েক ডজন আমলার বিরুদ্ধে। এরই মধ্যে আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা হারুন অর রশিদসহ অনেকের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। জালিয়াতি ও অনিয়মের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংকের প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা তুলে নিয়ে বিদেশে পাচার করার অভিযোগে শিল্পগোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়েছে। গত দেড় দশকে বাংলাদেশ থেকে যত অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে, সেগুলো ফিরিয়ে আনার বিষয়েও কার্যক্রম শুরু করেছে সরকার।

আর্থিক খাত সংস্কারে উদ্যোগ : আর্থিক খাতকে স্থিতিশীল করার জন্য পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে সরকার। ব্যাংকিং খাতের টেকসই সংস্কারে এরই মধ্যে আলাদা ব্যাংকিং কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। লুটপাটের শিকার হওয়া বেশ কিছু ব্যাংকের আগের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়ে পুনর্গঠন করা হয়েছে, যেগুলোর মধ্যে বেসরকারি খাতে সবচেয়ে বড় ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকও রয়েছে।

‘ব্যাংকিং খাতকে স্থিতিশীল করাই এখন আমাদের প্রায়োরিটি, এজন্য যা ব্যবস্থা নেওয়া দরকার সবই আমরা নিচ্ছি’ বলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর।

শিক্ষা খাতে যত পরিবর্তন : চলতি বছর নবম শ্রেণিতে বিভাগ বিভাজন তুলে দিয়ে নতুন যে শিক্ষাক্রম আওয়ামী লীগ সরকার চালু করেছিল, অন্তর্বর্তী সরকার সেটিতে সংস্কার এনে আবারও বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা শাখা চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

জনপ্রতিনিধিদের জায়গায় প্রশাসক : শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর মাত্র দশ দিনের ব্যবধানে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, জেলা ও উপজেলা মেয়র ও চেয়ারম্যানদের অপসারণ করে প্রশাসক নিয়োগ করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। পট পরিবর্তনের পর সরকার সমর্থিত জনপ্রতিনিধিরা আত্মগোপনে কিংবা পরিষদে না যাওয়ায় নাগরিক সেবা ব্যাহতের কারণে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়। স্থানীয় সরকারের ওই চারটি প্রতিষ্ঠানের পদ থেকে মেয়র ও চেয়ারম্যানদের অপসারণ করা হলেও ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ক্ষেত্রে ভিন্ন নীতি সরকারের।

নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে সক্রিয় জামায়াত : ক্ষমতা হারানোর চারদিন আগে অনেকটা তড়িঘড়ি করেই সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ১৮ নম্বর ধারায় ‘জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ’ ও তাদের ছাত্র সংগঠন ‘ইসলামী ছাত্রশিবির’কে নিষিদ্ধ করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু নতুন সরকার ক্ষমতায় বসার তৃতীয় সপ্তাহে এসে সিদ্ধান্ত বদলে গেছে। বাতিল করা হয়েছে আগের প্রজ্ঞাপন। ফলে দলটির নেতাকর্মীরা আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। এ ছাড়া ১৫ আগস্টের ছুটিও বাতিল করা হয়েছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close