নিজস্ব প্রতিবেদক
সড়কে আজ ফিরছে ট্রাফিক পুলিশ
শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগের পর ভেঙে পড়েছে পুলিশের চেইন অব কমান্ড। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে সবচেয়ে বেশি তোপের মুখে পড়েছে বাংলাদেশ পুলিশ। সারা দেশে বাহিনীটির থানা ও ট্রাফিক স্থাপনায় হামলা হয়েছে, সদস্যদের মারধর ও হত্যার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে পুলিশসহ সব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সরকার বা আওয়ামী ঘেঁষা কেউ আটক হন কেউবা আত্মগোপনে চলে যান। এমন পরিস্থিতিতে ভেঙে পড়েছে পুলিশের চেইন অব কমান্ড। পুলিশ বাহিনীকে পুনর্গঠন ও সংস্কারের দাবি যখন সবখানে তখন ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাও নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ট্রাফিক পুলিশ শূন্য ট্রাফিক সিগন্যাল ও সড়কে যান চলাচলের শৃঙ্খলার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে ছাত্র-জনতা।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা তথা আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন করছে ছাত্র-জনতা। সরকার পতনের পর গতকাল রবিবার সবচেয়ে বেশি যানবাহন সড়কে নেমেছে। খুলেছে সব সরকারি-বেসরকারি অফিস, কলকারখানা। তাই সকাল থেকে দিনভর সড়কে ছিল তীব্র যানজট। বেসামাল পরিস্থিতিতে রাজধানীর বেশ কয়েকটি জায়গায় পোশাকে ট্রাফিক ব্যবস্থায় ফিরতে শুরু করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন ট্রাফিক বিভাগ।
ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, আজ সোমবার সকাল থেকে ট্রাফিক বিভাগের সব পর্যায়ের কর্মকর্তাকে কর্মস্থলে যোগদানের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সংকটময় মুহূর্তে ট্রাফিক পুলিশ শূন্য নগরীতে ছাত্র প্রতিনিধি, সমন্বয়ক, সেনাবাহিনী, বিজিবি, ফায়ার সার্ভিস, বিএনসিসিসহ ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় সহযোগিতা করা সব পর্যায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে দিনভর যোগাযোগ ও সাক্ষাৎ করে সোমবার থেকে পুরোদমে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা স্বাভাবিক করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে ট্রাফিক বিভাগ।
রবিবার সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবসে সকাল থেকে তীব্র যানজট দেখা দেয়। অফিসগামী ও অফিস ছুটির সময়ে সে চাপ সড়কে বেসামাল পরিস্থিতি তৈরি করে। বৃষ্টির কারণে সড়কে চরম জনভোগান্তি দেখা দেয়।
মিরপুর থেকে মতিঝিলগামী মোটরসাইকেল আরোহী আবরার হোসেন বলেন, আড়াই ঘণ্টায় মিরপুর থেকে কাকরাইল পৌঁছাতে পেরেছি। কাজের কাজ কিছু বলে মনে হচ্ছে না। কারণ মতিঝিল পৌঁছাতেই অফিস টাইম পার। তিনি বলেন, এমন কোনো চেকপোস্ট বা ট্রাফিক সিগন্যাল নেই যেখানে যানজট নেই। চারদিকে গাড়ির চাপ। কিন্তু কোথাও নেই ট্রাফিক পুলিশ। ছাত্র-জনতা যে যেভাবে পারছে সড়কে শৃঙ্খলা রক্ষার চেষ্টা করছেন। সত্যিকার অর্থে বাস্তব পরিস্থিতি খুবই নাজুক সড়কে। সহসাই সড়কে ট্রাফিক পুলিশের কার্যক্রম এখন সময়ের দাবি।
বিজয় সরণি মোড়ে সিএনজি চালক রমজান আলী বলেন, কোন দিকে যাব বুঝতে পারছি না। যাত্রী উঠিয়ে বিপাকে আছি। পথ ঘুরিয়ে বিকল্প সড়কে ওঠার উপায় নাই। ব্যাপক যানজট। সব সড়কে চাপ। বৃষ্টি পথে পথে সে ভোগান্তি নিয়ে গেছে চরমে। পল্টন মনে হচ্ছে সপ্তাহের পথ।
এই প্রতিবেদক আগারগাঁও থেকে আড়াই ঘণ্টায় মিন্টো রোডে যান। এর ঘণ্টাখানেক পর ৩টায় রওনা দিয়ে সেগুনবাগিচা এলাকায় পৌঁছেন ৪৫ মিনিটে। অথচ এই পথ মাত্র ৩-৪ মিনিটের।
সরেজমিনে দেখা যায়, রাজধানীর মিরপুর, আগারগাঁও, উড়োজাহাজ ক্রসিং, বিজয় সরণি সিগন্যাল, তেজগাঁও, সাতরাস্তা, মিন্টো রোড, পুরো রমনার অলিগলি, কাকরাইল, মৎস্য ভবন এলাকা, প্রেস ক্লাব, পল্টন, নাইটিঙ্গেল মোড় পর্যন্ত তীব্র যানজট, কোথাও গাড়ির চাপ স্পষ্ট। ট্রাফিক সিগনালে একাধিক স্বেচ্ছাসেবী যুবকদের দেখা গেলেও সড়ক ছিল বেসামাল।
মিন্টো রোডের মুখে কথা হয় স্কুল পড়ুয়া আনোয়ার নামের এক কিশোর স্বেচ্ছাসেবীর সঙ্গে। সে বলে, আমাদের হাতে ওয়ারলেস সেট নেই। রাস্তায় কোথায় খারাপ কোথায় ভালো, কোথায় যানবাহন নষ্ট সেটা জানার উপায় নাই। যেখানে আছি সেখানেই লেন, সিগন্যাল চাপ সামলানোর কাজটা করছি। আপদকালীন এই চেষ্টাতেও অনেক নাগরিক সহযোগিতা করছেন না বিধায় সড়কের চাপটা বেসামাল হয়ে যাচ্ছে। নগরীর সড়কে এমন যখন পরিস্থিতি তখন রাজধানী তেজগাঁওয়ে চারটি ও গুলশানের তিনটি স্থানে ট্রাফিক পুলিশ কাজ শুরু করেছে।
গুলশান ট্রাফিক বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) আব্দুল মোমেন বলেন, দেশের পরিস্থিতি সবার জানা। ট্রাফিকিং পুরোটাই ভেঙে পড়েছিল। অনেক পুলিশ সদস্য জীবনের নিরাপত্তাহীনতা থেকে পালিয়েছিলেন। তারা ফিরছেন। আমার বিভাগে শুরু থেকে ট্রাফিক সদস্যরা কাজে যোগ দিলেও নিরাপত্তার কারণে সড়কে ছিল না।
তিনি বলেন, আইজিপি স্যারের নির্দেশে গুলশানে তিনটি স্থানে পোশাকে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা কাজ শুরু করেছেন। গুলশান-১, ২ ও কাকলী মোড়ে। এখানে ছাত্ররা আমাদের সহযোগিতা করছেন। সেনাবাহিনী ও বিজিবি সার্বক্ষণিক সহযোগিতায় টহলে রয়েছে। ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মুনিবুর রহমান এসে এ কার্যক্রম সরেজমিনে দেখে গেছেন। কাল থেকে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব কাঁধে নিচ্ছে ট্রাফিক বিভাগ। এই কয়েকদিন ছাত্র-জনতা যেভাবে ট্রাফিকিংয়ের দায়িত্বটা সামলেছে সেজন্য সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন তিনি।
যোগাযোগ করা হলে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মো. মুনিবুর রহমান বলেন, অনেকে যোগ দিয়েছে। অনেক ট্রাফিক পুলিশ সদস্য কাজে যোগ দেননি। সবাইকে আসতে বলা হয়েছে। প্রত্যেকটি ট্রাফিক বিভাগকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে যাতে করে সব জনবল কর্মস্থলে যোগ দেয়। আগামীকাল থেকে পুরোদমে ট্রাফিকের কাজে অংশ নিতে বলা হয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা আজ থেকেই চেষ্টাটা শুরু করেছি। কাল থেকে এটা পুরোপুরি কার্যকরের চেষ্টা করা হবে। গুলশান ও তেজগাঁওয়ে আমরা শুরু করেছি। উত্তরা ও রমনায় চেষ্টা করছি আজই শুরু করার। আশা করছি আগামীকাল থেকে সড়কে পোশাকে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা কাজে অংশ নেবেন। মো. মুনিবুর রহমান বলেন, আমরা ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। আজ দিনভর বিভিন্ন ট্রাফিক সিগনালে নিয়োজিত ছাত্রদের সঙ্গে আমরা সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছি।
এর আগে দুপুরে রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মো. ময়নুল ইসলাম বলেন, প্রায় ছয়দিন পর ঢাকায় কিছু সড়কে দায়িত্ব পালন শুরু করেছেন ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা। ধীরে ধীরে ঢাকার সব সড়কে কাজ শুরু করবেন তারা।
আইজিপি বলেন, আমাদের ট্রাফিকে জনবলের সমস্যা নেই। এরই মধ্যে ইন্টারকন্টিনেন্টাল সিগন্যাল থেকে জাহাঙ্গীর গেট পর্যন্ত ট্রাফিক পুলিশ সদস্য কাজ শুরু করেছেন। এসব জায়গায় অনেক বেশি ট্রাফিক পুলিশ সদস্য কাজ করছে। এসব সড়কে শিক্ষার্থী, বিএনসিসি ও স্কাউটের সদস্যরাও রয়েছেন। ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে যেন শিক্ষার্থীদের কোনো ভুলভ্রান্তি না হয় সেজন্য ছাত্র সমন্বয়কদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ আছে।
উল্লেখ্য, চাকরিতে কোটা সংস্কার চেয়ে আন্দোলন শুরু করেছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। শুরু থেকে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা, সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের মেজাজি বক্তব্য পর ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে নজিরবিহীন দমনপীড়ন, ধরপাকড় শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পরিস্থিতি বুঝেও শেষ সময়েও অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ এবং আরও রক্তপাতের মাধ্যমে ক্ষমতা ধরে রাখতে চেয়েছিলেন শেখ হাসিনা। পরিস্থিতি যখন একেবারেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে তখনও মানতে চাননি হাসিনা। পরে পরিবারের সদস্যরা বোঝানোর পর পদত্যাগে রাজি হন। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে পদত্যাগ করে গোপনে বোন শেখ রেহানাকে সঙ্গে নিয়ে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। কিন্তু মাঝে ঝরে যায় ছাত্র-জনতার চার শতাধিক প্রাণ। পেশিশক্তির ব্যবহার, সারা দেশে হতাহতের ঘটনায় ছাত্র-জনতার আন্দোলনের বড় ক্ষোভটা দেখা দেয় পুলিশের বিরুদ্ধে। শেখ হাসিনার পতনের পর পুলিশের অধিকাংশ কর্মকর্তা আত্মগোপনে চলে যান। ভেঙে পড়ে চেইন অব কমান্ড। মুখ থুবড়ে পড়ে পুলিশিং।
জানতে চাইলে বেসরকারি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী আজান বলেন, নির্দেশনা ছিল সড়কে শুধু বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা দায়িত্ব পালন করবেন। কিন্তু এখানে সকাল থেকে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাও আসছে। এতে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে ঝামেলা হচ্ছে। যদিও পরে তা ঠিক হয়ে গেছে।
পরিবহন চালক ও পথচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে অতিরিক্ত শিক্ষার্থীর উপস্থিতি সড়কে বিশৃঙ্খলা তৈরি করছে। পাঁচ জনে পাঁচ রকম সিগন্যাল দিচ্ছেন। যেখানে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে পাঁচজন প্রয়োজন সেখানে ১৫ জন নেমে পড়ছেন। সড়কে কয়েক মিটার পর পর ৩-৪ জন দাঁড়িয়ে সিগন্যাল দিচ্ছেন। এতে যানবাহন চলাচলে অসুবিধা হচ্ছে।
ওয়্যারলেস মোড়ে কথা হয় লাব্বাইক পরিবহন বাসের চালক রাশেদের সঙ্গে। তিনি বলেন, ওয়্যারলেস মোড়ে কখনো ট্রাফিক ছিল না। এখানে ট্রাফিকের দরকার হয় না। গত কয়েকদিন ধরে ফ্লাইওভারের মুখ থেকে শুরু করে মৌচাক মোড় পর্যন্ত সড়কে অনেক শিক্ষার্থী। যেখানে তিন-চারজন থাকলেই যথেষ্ট, সেখানে ১৫-২০ জন নেমে পড়ছেন। যাত্রী নামানো-উঠানোর জন্যও তারা সময় দিচ্ছেন না।
"