জবি প্রতিনিধি
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন, আতঙ্কে শিক্ষার্থীরা
রাজউকের আদেশ আমলে নেয়নি প্রশাসন * শতবর্ষী ভবনে প্রশাসনিক কাজ * ঝরে পড়ছে চুন-সুরকি
রাজধানী ঢাকা নগরীর ব্যস্ততম অংশ পুরান ঢাকার সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় অবস্থিত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। কমপক্ষে ২০ হাজার শিক্ষার্থীর এই বিদ্যাপীঠে প্রায় প্রতিটি ভবনই ঝুঁকিপূর্ণ। চলতি বছর গত ১০ মার্চ রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে এক বৈঠকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) চারটি ভবন দুমাসের মধ্যে ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেয় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এবং এই মর্মে তারা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে চিঠি প্রদান করে। এর আগে ২০১৩ সালে এক প্রতিবেদনে চার-পাঁচটি ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়।
এ ব্যাপারে জবি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ভবনগুলো রেট্রোফিটিং করে ব্যবহার উপযোগী করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে প্রশাসনিক ভবনে রেট্রোফিটিংয়ের কাজ শুরু হয়েছে, ক্রমশ সবগুলো ভবনই রেট্রোফিটিংয়ের আওতায় আনা হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসের পর কোনো কোনো ভবন বেশি ঝুঁকিপূর্ণ তা নির্ণয়ের জন্য জবি কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কয়েকজন বিশেষজ্ঞকে দায়িত্ব দেন। তারা জরিপ চালিয়ে জরিপের প্রতিবেদনও জমা দেন। সেই প্রতিবেদনে চার থেকে পাঁচটি ভবনকে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তারপর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ওই বছরের মে মাসে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোসহ অন্য ভবন সংস্কারের উদ্যোগ নিলেও নানা কারণে সেই উদ্যোগ ভেস্তে যায়।
অন্য ভবনগুলোয় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন ভবনের ছাদে ও দেয়ালে অনেক ফাটল রয়েছে। এগুলোর মধ্যে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ ভবন-২, পুরোনো কলা ভবন এবং বিজ্ঞান অনুষদের চারটি ভবনের অবস্থা জরাজীর্ণ। ২০২১ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৩তলা বিশিষ্ট বিবিএ ভবনের কাজ শেষ হওয়ার পর ঠিকাদারের কাছ থেকে প্রকল্প বুঝে নেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। কিন্তু সে ভবনেরও অনেক জায়গায় বড় আকৃতির ফাটল দেখা দিয়েছে। এমনকি প্রধান প্রকৌশলীর কক্ষের দেয়ালে ফাটল ধরেছে।
অন্যদিকে, ১১০ বছরের পুরোনো প্রশাসনিক ভবনটি ঘঁষামাজা করে চালানো হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সব ধরনের কার্যক্রম। নাম গোপন রাখার শর্তে একাধিক কর্মকর্তা জানান, ২০০৫ সালে জগন্নাথ কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করার পর ১৯১০ সালে নির্মিত প্রশাসনিক ভবনটি ৬০ লাখ টাকা ব্যয়ে সংস্কার করে প্রশাসনিক কার্যক্রম শুরু করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য ড. সিরাজুল ইসলাম খান। তবে সে সময় এটি স্থপতি দিয়ে পরীক্ষা করানো হয়নি বলে তারা জানান, এই ভবনটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
এদিকে চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ১০টি হালকা ও মাঝারি ধরনের ভূমিকম্প সংঘটিত হয়েছে দেশে। এতে জানমালের তেমন ক্ষতি না হলেও বড় ধরনের ভূমিকম্পের আভাস পাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানতে পারে। এতে আতঙ্ক বিরাজ করছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সিফাত রহমান বলেন, দেশে ইদানীং যে হারে ভূমিকম্প হচ্ছে, তাতে আমাদের মধ্যে ভয় জন্ম নিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ ভবনের অবস্থা নাজুক। ভবনগুলোকে কিছুদিন পরপর রং দিয়ে ওপরে ওপরে সংস্কার করা হয়, যেন বাইরে থেকে বোঝা না যায় বিল্ডিংগুলো খুবই মজবুত অবস্থায় আছে। প্রশাসনের উচিত এই ক্যাম্পাসের ভবনগুলো জোড়াতালি না দিয়ে নতুন ক্যাম্পাসের কাজ দ্রুত বাস্তবায়ন করা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রশাসনিক কর্মকর্তা বলেন, আমরা যে ভবনে বসে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম পরিচালনা করছি সে ভবনটির অবস্থা ভয়াবহ। প্রতিনিয়ত ছাদ থেকে খসে পড়ছে চুন সুরকি। যতক্ষণ অফিসে থাকি মনের মধ্যে আতঙ্ক থাকে। যদি বড় মাত্রার ভূমিকম্প হয় তাহলে এ ভবন খুব সহজেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
রাজউকের চিঠির বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী হেলাল উদ্দিন পাটোয়ারীর বলেন, আমরা চিঠি পেয়েছি কিন্তু সেখানে চারটি ভবনের কথা উল্লেখ ছিল। তবে সেই ঝুঁকিপূর্ণ ভবন কোনটি সেটি বলা হয়নি। তারা (রাজউক) যে সার্ভে করেছে সে বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউই অবগত নন। আমাদের কারো সঙ্গে কোনো ধরনের আলাপ-আলোচনা না করেই তারা চিঠি দিয়েছে। আর চাইলেই চারটি ভবন ভেঙে ফেলার সুযোগ নেই। তার আগে বিকল্প ব্যবস্থা করতে হবে। সেটার জন্যও সময় প্রয়োজন। তিনি আরো বলেন, আমরা ভবনগুলোকে রেট্রোফিটিং করার জন্য একটি কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তারা প্রশাসনিক ভবনের কাজ এরই মধ্যে শুরু করেছে। এরপর একটি ডিজাইন দিলে বাকি কাজও শুরু হবে। ক্রমান্বয়ে সব ভবনকে এ প্রকল্পের আওতায় আনার পরিকল্পনা চলছে।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ ও রুটিন দায়িত্বে ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দীন আহমেদ বলেন, সরকার আমাদের যে নির্দেশনা দেবে আমরা সেটা অনুসরণ করার চেষ্টা করব। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ভবনই ঝুঁকিপূর্ণ। হুট করেই তো এগুলো ভেঙে ফেলা সম্ভব নয়। তার আগে বিকল্প ব্যবস্থা করতে হবে আমাদের। আমরা ভবনগুলো রেট্রোফিটিং করে ব্যবহার উপযোগী করার চেষ্টা করছি। এরই মধ্যে প্রশাসনিক ভবনে রেট্রোফিটিংয়ের কাজ শুরু হয়েছে, সামনে সবগুলো ভবনই রেট্রোফিটিংয়ের আওতায় আনা হবে।
"