বলরাম দাশ অনুপম, কক্সবাজার

  ২১ নভেম্বর, ২০২২

উপকূলে জীবনযুদ্ধ

বছরে প্রায় ১০০ বাড়ি সাগরে বিলীন হচ্ছে

বিধ্বস্ত বাঁধে পলিথিনে মোড়ানো ঝুপড়ি ঘর। জোয়ারের তোড়ে সেই ঘরের অর্ধেক বিলীন সাগরে। যেটুকু আছে সেখানেই টিকে থাকার সংগ্রামে পঁয়ত্রিশোর্ধ্ব খতিজা বেগম। হেমন্তের পড়ন্ত বিকালে এ নারীর দুচোখ পশ্চিমের সাগর থেকেই সরছে না। কাছে যেতেই ভারী গলায় বলে উঠলেন, কী জীবন কাটাব এখানে? সাগরের সঙ্গে কি পেরে উঠব আমরা? আলাপকালে খতিজা বেগম বলেন, আমার স্বামীর ভিটেবাড়ি ছিল। ১৮ বছরের ভাঙা-গড়ার জীবনে সবকিছুই সাগরে বিলীন হয়েছে। এ পর্যন্ত ৭ বার ঘর বেঁধেছি কিন্তু বছর ঘুরতেই নিঃস হই। তার ওপর সংসারে অভাব নিত্যসঙ্গী। জমি-জমাও নেই। বাঁধই এখন আমাদের শেষ ঠিকানা। এ নারীর পৈতৃক নিবাস কুতুবদিয়ার আলী আকবর ডেইল। দেড় যুগ আগে মহেশখালীর মাতারবাড়ির মৃত আবদুল করিমের ছেলে জসিম উদ্দিনের সঙ্গে বিয়ে হয় তার। সেই সুবাদে বাস করেন ষাইটপাড়ায়।

খতিজার ঝুপড়ি ঘরের লাগোয়া স্বামী ও দুই সন্তান নিয়ে থাকেন কোহিনূর আক্তার। সেও দিল দুর্বিষহ এক রাতের বর্ণনা। কোহিনুর স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘সেদিন ছিল ভরা অমাবশ্যা। পলিথিন মোড়ানো ছনের চাউনির ঘরে রাত সাড়ে ১১টার দিকে বাঁধ উপচে পানি প্রবেশ করে। আমার স্বামী আবদুল মোনাফ ছিলেন না। এক বছর বয়সি সন্তান রবিউল হোসাইনকে নিয়ে অনেক ভয়ে ছিলাম। পরে আমার চিৎকার শুনে পার্শ্ববর্তী বাসিন্দারা এগিয়ে আসেন। এরপর চাল কেটে আমাকে উদ্ধার করে বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়।’

তিনি বলেন, ‘পরদিন সকালে এসে দেখি সহায় সম্পদ ও ঘর পানিতে ভেসে গেছে। এরপর থেকে পরের বাড়িতে আশ্রয়ে আছি। রাত হলে এখনো ভয়ে বুক কাঁপে।’ পার্শ্ববর্তী জরবাহারুর (৫৫) এর আক্ষেপ, ‘ঘরের কষ্টে খেতে পারি না, ঘুমাতে পারি না। কবে যে এই সাগর মুক্তি দেবে সেই চিন্তায় দিন কাটছে।’ এতো গেল মাতারবাড়ির ষাইটপাড়ার চিত্র। পার্শ্ববর্তী ধলঘাটার অবস্থা নাজুক।

সরাইতলার মরিয়ম খাতুন (৬৪) বলেন, ‘৬ বছরে ১০ বার ঘর বেঁধেও টিকতে পারিনি। বর্ষায় অন্যত্র সরে যাই, পানি নেমে গেলে চলে আসি। এভাবে চলছে জীবন।’ তিনি পশ্চিমের সাগরের দিকে আঙ্গুলের ইশারা দিয়ে আরো বলেন, ‘ঐ-যে দেখছেন সাগর, সেখানে আমার দুই কানি জমির ভিটেবাড়ি ছিল।’

এ এলাকার নুর বেগম বলেন, ‘পলিথিনের ওপর ইট আর প্লাস্টিকের বস্তা মুড়িয়ে কোনো মতে টিকে আছি।’

সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, শুধু খতিজা, কোহিনুর কিংবা মরিয়ম খাতুনই নন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাকে মাতারবাড়ি-ধলঘাটার প্রতিটি মানুষের মন বিষণ্নতায় ভরে উঠে। কিন্তু দীর্ঘদিনের দাবি ‘টেকসই বাঁধ’ আর ‘স্থায়ী ঘরের’ স্বপ্ন পূরণ হয় না। স্থানীয়রা জানিয়েছে, প্রতি বছর ৮০ থেকে ১০০টি বাড়ি সাগরে বিলীন হচ্ছে।

মাতারবাড়ির ৮নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য সরওয়ার কামাল বলেন, ‘ষাইটপাড়া ও জালিয়াপাড়া সংলগ্ন বাঁধে ৮০০ পরিবারের বাস। এদের কারো স্থায়ী ঠিকানা নেই। তারা ঘন ঘন ভাঙনের কবলে পড়েন। সর্বশেষ ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে নয়াপাড়া পয়েন্টের বাঁধ ভেঙে ৩০টি বাড়ি বিলীন হয়েছে। পাশাপাশি ৩০০ একর জমিনের আমন ধান লোনা পানিতে নষ্ট হয়েছে।’

মাতারবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান এস এম আবু হায়দার বলেন, ‘বাঁধে বসবাসকারী ৫০০ পরিবারকে পুনর্বাসনের জন্য তালিকা ও জমিও নির্ধারণ হয়েছে। শিগগিরই কার্যক্রম শুরু হবে।’

ধলঘাটার ইউপি চেয়ারম্যান কামরুল হাসান বলেন, ‘ইউনিয়নে ৮ কিলোমিটার বাঁধের মধ্যে সাপমারার ডেইলের কিছু অংশে জিওব্যাগ দিয়ে ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা করছে পাউবো। তবে সরাইতলার ২ কিলোমিটার খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এছাড়া কুহেলিয়া চ্যানেলের উলাখালী ঘোনা থেকে সাপমারার ডেইল পর্যন্ত ১ কিলোমিটারও ঝুঁকিতে।’ ইউপি চেয়ারম্যান কামরুল হাসান বলেন, ‘টেকসই বাঁধ নির্মাণে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে একাধিবার জানিয়েছে। কিন্তু তারা আশ্বস্ত করে, উদ্যোগ নেয় না। ফলে এলাকাবাসী ক্ষুব্ধ। সরকার সুপার ডাইক বেড়িবাঁধ নির্মাণের কথা বলছে। আমরা সেটির দ্রুত বাস্তবায়ন চাই। পাশাপাশি বাঁধে বসবাসরতদের পুনর্বাসনে ঊর্ধ্বতন মহলে আবেদন করেছি।’

এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী ড. তানজির সাইফ আহমেদ বলেন, ‘স্থানীয়দের রক্ষায় ঠিকাদার নিয়োগ করে ভাঙনকৃত বাঁধ পুনরায় সংস্কার করা হয়েছে। পাশাপাশি মাতারবাড়ি-ধলঘাটায় ২৮৪৬ কোটি ৯৫ লাখ টাকা ব্যয়ে ১৭.৭৫ কিলোমিটার টেকসই সুপার ডাইক বাঁধ নির্মাণে নকশা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের অপেক্ষায়।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close