ক্রীড়া প্রতিবেদক
দেশকে জোড়া শিরোপা এনে দিলেও ভাগ্য বদলায়নি মনিকার
সারা দেশের মতো সাফ শিরোপা জয়ের আনন্দ ছড়িয়ে পড়েছে পাহাড়ের অজ পাড়া গায়েও। সে আনন্দ আর কোথাও নয়, মনিকা চাকমার গ্রামের বাড়ি খাগড়াছড়ি জেলার লক্ষ্মীছড়ি উপজেলার দুর্গম সুমন্ত পাড়া গ্রামে। যে গ্রাম থেকে মনিকা এখন জাতীয় নারী ফুটবল দলের তারকা খেলোয়াড়। তবে জোড়া শিরোপা জয়ে বাংলাদেশেকে বিশ্ব দরবারে পরিচিত করালেও ভাগ্য বদল হয়নি মনিকাদের। প্রতিবারই প্রতিশ্রুতির বন্যায় ভাসলেও মনিকাদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা রাস্তা, ব্রিজ, বিদ্যুৎ সংযোগসহ অন্যান্য প্রতিশ্রুতি দিয়েও সেটা রক্ষা না করায় হতাশ মনিকার পরিবার ও প্রতিবেশীরা।
গত ৩০ অক্টোবর কাঠমান্ডুর দশরথ স্টেডিয়ামে নেপালকে ২-১ গোলে হারিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট জিতেছে বাংলাদেশের মেয়েরা। এবার মনিকা চাকমা ও ঋতুপর্ণা চাকমার গোলে শিরোপা ধরে রাখে লাল-সবুজরা।
টানা দ্বিতীয় বারের মতো শিরোপা জয়ে সারা দেশে আনন্দের বন্যা বইছে। সেই আনন্দ ছড়িয়ে পড়েছে খাগড়াছড়ি জেলার লক্ষীছড়ি উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার দুরে দুর্গম সুমন্ত পাড়া গ্রামেও । যে গ্রামে বেড়ে উঠেছিল মনিকা চাকমা। মনিকা চাকমার বেড়ে উঠা সহজ ছিল না। তার বাবা বিন্দু কুমার চাকমা বলেন সাফ ফুটবলে বাংলাদেশ জয় লাভ করায় আমি খুশি, গ্রামবাসীরাও খুশি হয়েছে। এ জয়ে খুশি পুরো উপজেলাসহ জেলাবাসী। মনিকা চাকমা বাড়িতে না থাকলেও পাহাড়িদের পাশাপাশি অনেক বাঙ্গালিও তার বাবা-মার কাছে ছুটে গেছেন আনন্দ ভাগাভাগি করার জন্য। স্থানীয়দের প্রত্যাশা, আগামী সাফে ধারাবাহিকতা ধরে রেখে মনিকারা দেশকে হ্যাটট্রিক শিরোপা এনে দেবে।
মনিকা এখন নিজ এলাকার রোল মডেল। তাকে দেখে এখন অনেক ছেলে-মেয়ে ফুটবল খেলায় আগ্রহী হয়েছে। মনিকার মতো যাতে আরও ফুটবলার গড়ে উঠবে সে চেষ্টাও করছেন তারা। সে অনেক কষ্টে উঠে এসেছে, সে যেন ভবিষ্যতে ভালোভাবে চলতে পারে সরকার যেন সে ব্যবস্থা দেন এ প্রত্যাশা এলাকাবাসীর। তবে মনিকার চাকমার গ্রামে যেতে হলে দুর্গম কাচা রাস্তা ও সাঁকো পার হয়ে যেতে হয়। বিশেষ করে বর্ষাকালে অনেক কষ্টে যেতে হয়। নেই কোনো সুপেয় পানির ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক। ২০২২ সালে প্রথমবার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর পূর্ববর্তী সরকার মনিকার বাড়িতে যাওয়ার জন্য রাস্তা, একটি সেতু, বিদ্যুৎ, ঘর করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও একটি ঘর ছাড়া আর কোনো কিছু করে দেননি। স্থানীয়দের প্রত্যাশা ও দাবি দেশের সুনাম বয়ে আনা মনিকার সমস্যাগুলো যেন বর্তমান সরকার বাস্তবায়ন করে।
২০০৩ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ির লক্ষীছড়ি উপজেলার প্রত্যন্ত এক গ্রামে মনিকার জন্ম। মনিকার এ পর্যায়ে আসার পথটা মসৃণ ছিল না। এগিয়ে চলার পথে বারবার বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল পরিবার ও সমাজ। তারপরও দমে যাননি। এগিয়ে গেছেন স্বপ্ন পূরণে। কৃষক পরিবারে জন্ম নেওয়া মনিকা এখন সকলের পরিচিত মুখ। ফুটবলের প্রতি মনিকার বাবা বিন্দু কুমার চাকমা ও মা রবি মালা চাকমার আগ্রহ ছিল না। তাই বাবার চোখ ফাঁকি দিয়ে চুরি করে ফুটবল খেলতেন। ২০১১ ‘তে বঙ্গমাতা গোল্ডকাপ ফুটবল দিয়ে জেলা ক্রীড়া সংস্থার নজরে আসেন।
২০১২ সালে শ্রীলংকায় অনুষ্ঠিত এএফসির টুর্নামেন্টে অংশ নিয়ে মনিকা গোল করেছিলেন তিনটি। এর পরের গল্পটা শুধুই মনিকার এগিয়ে যাওয়ার। ২০১৩ থেকে পেশাদার ফুটবলে যাত্রা শুরু করা মনিকা বয়সভিত্তিক ফুটবলের ধাপ পেরিয়ে ২০১৯ এ প্রথম সুযোগ পান জাতীয় দলে। দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট ছিনিয়ে আনতে পারায় সারা দেশের মানুষের মতো খুশি মনিকার পরিবারের সদস্যরাও। তবে পূর্বের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন না হওয়ায় ক্ষোভ মনিকার পরিবারে।
নেপালকে কাঁদিয়ে বাংলাদেশ সাফ চ্যাম্পিয়ান হওয়ায় আবারও মনিকার বাড়িতে ফুল-মিষ্টি নিয়ে ছুটছেন প্রশাসনের কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিসহ সমাজের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। আগের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত না হলেও আবারও ভাসাচ্ছেন প্রতিশ্রুতির বন্যায়। তবে লক্ষীছড়ি উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা ছেনমং রাখাইন জানান, আগের জেলা প্রশাসক যে রাস্তা করে দেয়ার কথা বলেছিলেন, সেটা নিয়ে কাজ করা হবে। এছাড়া জেলা প্রশাসকের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে মনিকার সমস্যা গুলো সমাধানের ব্যবস্থা করা হবে। এদিকে লক্ষীছড়ি উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সুপার জ্যোতি চাকমা জানান, মনিকার কীর্তিতে খুশি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রতিবেশীরা। পূর্বের জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন চান তারা।
"