ক্রীড়া ডেস্ক
ভারতে বিরাট লজ্জা
নিউজিল্যান্ডের ইতিহাস
স্লগ সুইপের চেষ্টায় ব্যটে-বলে করতে পারলেন না ওয়াশিংটন সুন্দার। বল ছোবল দিল স্টাম্পে। হুঙ্কার ছুড়লেন বোলার এজাজ প্যাটেল। তাকে ঘিরে উচ্ছ্বাসে মেতে উঠলেন সতীর্থরা। ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে তখন আর কোনো আওয়াজ নেই। গ্যালারিতে যেন শ্মশানের নীরবতা। মাঠে গোল হয়ে উদযাপনে মেতে ওঠা নিউজিল্যান্ড। এমন আনন্দ তো হবেই। ক্রিকেট ইতিহাসের কোনো দল যা পারেনি, সেটিই করে দেখাল এই কিউরা। ঘরের মাঠ যাদের দুর্গ, দেশের মাঠে যারা অপ্রতিরোধ্য ও অপরাজেয়, সেই ভারতকে হোয়াইটওয়াশ করে দিল কিউইরা!
মুম্বাই টেস্টে রিশাভ পান্টের ঝড় থামিয়ে রোমাঞ্চের দোলায় ভেসে ২৫ রানের স্মরণীয় জয় পেল নিউজিল্যান্ড। সিরিজটিও তাদের ক্রিকেট ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে রইল অনন্য সাফল্যে।দেশের মাঠে তিন বা এর বেশি ম্যাচের টেস্ট সিরিজে প্রথমবার হোয়াইটওয়াশ হলো ভারত।
১১ উইকেট নিয়ে এই জয়ের নায়ক এজাজ প্যাটেল। প্রথম ইনিংসে পাঁচ উইকেট নেওয়া বাঁহাতি স্পিনার দ্বিতীয় ইনিংসে শিকার করলেন ছয় উইকেট।
টেস্ট ইতিহাসের তৃতীয় বোলার হিসেবে ইনিংসে ১০ উইকেটে সবকটি নিয়েছিলেন তিনি এই মাঠেই। ২০২১ সালে সেই ম্যাচে তিনি মোট ১৪ উইকেট নেওয়ার পরও হেরেছিল নিউ জিল্যান্ড । এবার ১১ উইকেট নিয়ে ৩৬ বছর বয়সি স্পিনার দলকে এনে দিলেন মনে রাখার মতো জয়।
১৯৮৮ সালে তার জন্ম এই মুম্বাইয়েরই (সেই সময়ের মুম্বাই) এক গুজরাটি মুসলিম পরিবারে। জীবন এরপর তাকে নিয়ে গেছে নিউজিল্যান্ডে। কিন্তু এখন তিনি ঠিকই মুম্বাইয়ের ‘রাজা’। ইয়ান বোথামকে (২২ উইকেট) পেছনে ফেলে সফরকারী বোলারদের মধ্যে ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামের সফলতম বোলার এখন তিনিই।
শেষ ইনিংসে নিউজিল্যান্ড ও ইতিহাসের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিলেন কেবল পান্ত। ৫৭ বলে ৬৪ রান করে ভারতের কিপার-ব্যাটসম্যান বিদায় নেন এজাজের বলেই।
৯ উইকেটে ১৭১ রান নিয়ে গতকাল দিনের শুরু করে নিউজিল্যান্ড। আর স্রেফ তিন রান যোগ করেই শেষ হয় তাদের ইনিংস। শেষ উইকেট নিয়ে ইনিংসে পাঁচ আর ম্যাচে ১০ উইকেট পূর্ণ করেন রাভিন্দ্রা জাদেজা।
এই নিয়ে ১৫ বার তিনি পেলেন ইনিংসে পাঁচ উইকেট, ম্যাচে ১০ উইকেট তৃতীয়বার।
তবে ভারতের মূল চ্যালেঞ্জ ছিল এরপরই। ভীষণ শুষ্ক এবং এমন টার্নিং উইকেট ১৪৭ রানের লক্ষ্যও সহজ ছিল না মোটেও। আগের দিন শেষেই টিভিতে আলোচনায় ভারতের স্পিন কিংবদন্তি অনিল কুম্বলে বলেছিলেন, এই উইকেটে দেড়শ রান তাড়া করতে হলেও ম্যাচে সম্ভাবনা ৫০-৫০। শেষ পর্যন্ত দারুণ রোমাঞ্চ ছড়িয়েই জিতল কিউইরা।
ভারতের রান তাড়ায় শুরুতে যদিও আগ্রাসী হওয়ার চেষ্টা করেন রোহিত শার্মা। এই উইকেটে শুরুতে একটি ঝড়ো ইনিংস খেলতে পারলে ম্যাচের প্রেক্ষাপটে তা হবে গুরুত্বপূর্ণ, জানতেন ভারতীয় অধিনায়ক। প্রথম ওভারে ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে ম্যাট হেনরিকে চার মারেন তিনি, পরের ওভারে এজাজ প্যাটেলকে রিভার্স সুইপে।
তবে অতি আগ্রাসন ডেকে আনে তার পতন। হেনরির অফ স্টাম্পের বাইরের লেংথ বল তুলে মারতে গিয়ে উইকট বিলিয়ে ফেরেন তিনি।
এরপর এজাজের ছোবল ভারতের ব্যাটিং অর্ডার ভেঙে পড়ে তাসের ঘরের মতো। বল ছেড়ে দিয়ে বোল্ড হন শুবমান গিল। স্লিপে ড্যারিল মিচেলের দারুণ ক্যাচে ভিরাট কোহলি ফেরেন এক রানে।
সিরিজের ছয় ইনিংসে রোহিত ও কোহলির প্রাপ্তি স্রেফ একটি করে ফিফটি।
আগ্রাসনের চেষ্টায়ই এজাজের ফুল টসে ক্যাচ দিয়ে বসেন সারফারাজ খান। মাঝে ইয়াসাসভি জয়সওয়ালকে ফেরান গ্লেন ফিলিপস।
ভারত ৫ উইকেট হারায় ২৯ রানে।
এরপর শুরু হয় পান্টের পাল্টা আক্রমণ, আদতে যা তার সহজাত ব্যাটিং। ক্রিজে যাওয়ার পরপরই ছক্কায় শুরু করেন তিনি। চাপের মধ্যেও নিজের মতো করেই ছুটতে থাকেন দারুণ সব শট খেলে।
তাকে ফেরানোর বড় একটি সুযোগ নিউজিল্যান্ড পেয়েছিল। এজাজের বল লেগেছিল তার প্যাডে। আম্পায়ার আউট দেননি। তবে পরে দেখা যায়, রিভিউ নিলেই আউট হতেন পান্ট।
২১ রানে রক্ষা পাওয়া সেই পান্ট নিউজিল্যান্ডের হাত থেকে ম্যাচ বের করে নেওয়ার হুমকিই দিচ্ছিলেন। টেস্ট ক্যারিয়ারে অসাধারণ কিছু ইনিংস তিনি এর মধ্যেই খেলেছেন। তবে শেষ পর্যন্ত এবার আর ম্যাচ জেতানো ইনিংস খেলতে পারেননি।
লাঞ্চের পর রিভিউ নিয়ে তাকে ফেরান এজাজ। নিউজিল্যান্ডের উল্লাসেই ফুটে উঠছিল, জয়ের সুবাস তারা পেয়ে গেছেন।
ভারতের জয়ের জন্য তখন লাগে ৪১ রান। ওয়াশিংটন সুন্দার ও রাভিচান্দ্রান অশ্বিন তখন ক্রিজে। যথেষ্ট ভালো ব্যাটসম্যান দুজনই। কিন্তু এই উইকেটে যে কাজটা কঠিন!
অশ্বিন বিদায় নেন রিভার্স সুইপের চেষ্টায়। পরের বলেই দারুণ টার্নে আকাশ দিপকে বোল্ড করেন ফিলিপস।
তবে ম্যাচের শেষটা তো এজাজকে দিয়েই হতে হতো! ভারতের শেষ ভরসা ওয়াশিংটনকে বোল্ড করে ম্যাচও শেষ করে দেন এই বাঁহাতি স্পিনার।
ম্যান অব দা ম্যাচ তো অবধারিতভাবেই এজাজ প্যাটেল। এই ম্যাচে জোড়া ফিফটি করা উইল ইয়াং জেতেন ম্যান অব দা সিরিজের পুরস্কার। অথচ কেন উইলিয়ামসন থাকলে হয়তো তিনি খেলার সুযোগই পেতেন না।
এবারের আগে প্রায় ৭০ বছরে ১২ বারের ভারত সফরে কোনো সিরিজ জয় ছিল না নিউজিল্যান্ডে। আগের ৩৬ টেস্টে জয় ছিল মোটে দুটি। এই সফরে তারা পায়নি দলের সেরা ব্যাটসম্যান কেন উইলিয়ামসনকে। কদিন আগে তারা বাজেভাবে হেরে এসেছে শ্রীলঙ্কায় গিয়ে। সেই দলটিই এবার চমকে দিল গোটা ক্রিকেট বিশ্বকে। পুনে টেস্টে হেরে দেশের মাঠে ১২ বছর পর প্রথম সিরিজ হারল ভারত।
পুনেতে নিউজিল্যান্ডের জয়ের নায়ক মিচেল স্যান্টনার মুম্বাইয়ে খেলতে পারেননি চোটের কারণে। তার পরও ভারত হেরে গেল আবার, প্রথমবার তিন ম্যাচের সিরিজে হোয়াইওয়াশ হলো তারা দেশের মাঠে। নিয়মিত অধিনায়ক হিসেবে টম ল্যাথামের যাত্রা শুরু হলো অভাবনীয় সাফল্যে।
সংক্ষিপ্ত স্কোর
নিউজিল্যান্ড প্রথম ইনিংস : ২৩৫
ভারত প্রম ইনিংস : ২৬৩
নিউজিল্যান্ড দ্বিতীয় ইনিংস : ১৭৪
ভারত দ্বিতীয় ইনিংস : ১২১
ফল : নিউজিল্যান্ড ২৫ রানে জয়ী
ফল : তিন ম্যাচ সিরিজে নিউজিল্যান্ড ৩-০ ব্যবধানে জয়ী
ম্যান অব দ্য ম্যাচ : এজাজ প্যাটেল
ম্যান অব দ্য সিরিজ : উইল ইয়াং
"