ক্রীড়া ডেস্ক
‘চাপে ভেঙে পড়ার রোগ আছে বাংলাদেশের’

তাদের সবাই এখন একসঙ্গে বুড়ো হচ্ছেন। ক্রমেই আরো বার্ধক্যের দিকে এগিয়ে যেতে থাকার এই সময়টিতে সাবেক সতীর্থদের কারো কারো সঙ্গে অলিখিত এক প্রতিযোগিতাও যেন চলছে অর্জুনা রানাতুঙ্গার। কিসের প্রতিযোগিতা? তার নিজের মুখ থেকে শুনলেই বুঝতে সুুবিধা হবে, ‘রোশান (মহানামা) আমার আগেই দাদা হয়ে গেছে!’ ১৯৯৬ সালে শ্রীলঙ্কার বিশ্বজয়ী দলের নির্ভরযোগ্য ব্যাটার এ ক্ষেত্রে এগিয়ে গেলেও অচিরেই তাকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রহর গুনতে শুরু করে দিয়েছেন তার অধিনায়ক, ‘আমিও দাদা হয়েছি। ভালো খবর হলো আমার মেয়েও এখন সন্তান সম্ভাবনা। আসছে নভেম্বরে আমি নানা হতে যাচ্ছি।’ বয়সটিই এমন যে নাতি-নাতনিদের নিয়ে আলাদা এক জগৎই তৈরি হয়ে যায়। সেই জগতে ডুবে থাকা রানাতুঙ্গা স্মার্টফোন বের করে নাতির ছবি দেখাতে দেখাতে অন্য রকম ভালো লাগায়ও আচ্ছন্ন হয়ে গেলেন, ‘এই দেখুন না, ও আমার বুকে ঘুমায়। কিন্তু রাত যত বাড়তে থাকে, নামতে নামতে সে পেটের ওপর চলে যায়।
নাতির নাম রেখেছেন সাহাস। সিংহলি ভাষার এই শব্দের মানেও বাংলায় একই সাহস! খুব শখ ছিল নাতির নামের সঙ্গে ‘অর্জুনা’ও যোগ করে দেবেন। কিন্তু বাদ সেধেছেন সাধারণ একটি দলকে বিশ্ব শ্রেষ্ঠত্বের চূড়ায় পৌঁছে দেওয়া অধিনায়কের মা, ‘আমার অনেক কিছুই পছন্দ নয় মায়ের। এই যে মাস ছয়েক হলো গোঁফ রেখেছি, ওনার তা একদমই ভালো লাগছে না। নিজের নামে নাতির নাম রাখতে গিয়েও পারলাম না। তার সাফ কথা, আমাদের পরিবারে একটি অর্জুনাই নাকি যথেষ্ট। আর দরকার নেই।’ তা-ও এই ভেবে স্বস্তি পান যে তার পরিবারে রেলগাড়ির মতো লম্বা নাম রাখার রেওয়াজটা এখন আর নেই, ‘আমার বাবার পুরো নাম শুনবেন? জয়াসেকারা কাঙ্কানা মালাগে ডন রিজি পাদমাসেনা রানাতুঙ্গা!’ পরিবারের নতুন সদস্যদের নামের মতো নিজের শরীরটাও আঁটসাঁট করে আনা রানাতুঙ্গাকে এখন দেখলে চেনাই যায় না!
যথারীতি অন্যায়-অনিয়ম নিয়ে ভীষণ প্রতিবাদী, ‘হাম্বানটোটায় গভীর সমুদ্রবন্দর করার পরিকল্পনাটি উচ্চাভিলাষী মনে হওয়ায় আমি এর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলাম। সে জন্য আমার মন্ত্রিত্বও গিয়েছিল।’ দুর্নীতির ভোগে চলে যেতে থাকা শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট প্রশাসন নিয়েও বিরক্তি প্রকাশ করলেন প্রায় ২০ মিনিট ধরে।
বিরক্ত তিনি সাবেক ক্রিকেটারদের ওপরও। বিশেষ করে এশিয়া কাপ শুরু হয়ে যাওয়ার পর নিয়ম বদলানো নিয়ে ভীষণ সোচ্চার রানাতুঙ্গা। সুপার ফোরে শুধু ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের রিজার্ভ ডে রাখা নিয়ে একহাত নিলেন খেলা ছাড়ার পরও নানা ভূমিকায় ক্রিকেটের সঙ্গে যুক্ত থাকা সাবেকদের, ‘ফুটবলে দুই সেরা দলের জন্য কি নিয়ম বদলায়? এখানে বদলানোর পর কোনো সাবেক ক্রিকেটারকে তা নিয়ে একটি কথাও বলতে শুনেছেন? শোনেননি কারণ কেউ কোচিং করায়, কেউ কমেন্ট্রি করে। ওদের কেউই এসব নিয়ে কথা বলে টাকা হারাতে চায় না।’
তার কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হলো বিশ্ব ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসিকেও, ‘একেবারে দন্তহীন একটি সংস্থা। ক্রিকেটারদের দুর্নীতি বা ম্যাচ ফিক্সিংয়ের ক্ষেত্রে একবিন্দুও ছাড় দেয় না তারা। কিন্তু শ্রীলঙ্কার মতো দুর্নীতিতে ডুবে থাকা ক্রিকেট বোর্ড নিয়ে কোনো মাথাব্যথাই নেই ওদের। ওরা তখন ঘুমিয়ে থাকে।’ নিজ দেশের ক্রিকেটের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে চলা রানাতুঙ্গা খেলা দেখতে এখন আর মাঠেও যান না। তবে টিভিতে কোনো খেলা মিসও দেন না।
এই এশিয়া কাপের বাংলাদেশকে নিবিড়ভাবে দেখার অভিজ্ঞতায় ধরিয়ে দিতে চাওয়া সমস্যাটি এই জায়গায়, ‘খেলা তো দেখলাম। প্রতিভার কোনো অভাব নেই বাংলাদেশের। ফাস্ট বোলিং আক্রমণও বেশ। কিন্তু সমস্যা হলো বাংলাদেশের ধারাবাহিকতা বলতে কিছু নেই। অনেক ক্ষেত্রেই চাপ সামাল দিতে পারে না ওরা। বিশেষ করে প্রতিপক্ষ যখন বড় নামের হয়, তখন চাপে ভেঙে পড়ার রোগ আছে বাংলাদেশের।’ এই রোগের নিরাময়ও ক্রিকেটারদেরই করতে হবে বলে মনে করেন শ্রীলঙ্কার বিশ্বজয়ী অধিনায়ক, ‘এই জিনিস তো কোচরা ঠিক করে দিতে পারবে না। চাপে অনড় থাকার ব্যাপারটি ওদের নিজেদেরই রপ্ত করতে হবে।’ তারপরও আসন্ন বিশ্বকাপে বাংলাদেশের বড় কিছু ঘটিয়ে দেওয়ার সম্ভাবনাও রানাতুঙ্গা নাকচ করে দিতে পারছেন না এ জন্য, ‘বাংলাদেশের এই দলটি পাকিস্তানের মতোই অনিশ্চিত চরিত্রের ভীষণ অধারাবাহিক একটি দল। একদিন দুর্দান্ত খেলে তো পরদিন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। এই চরিত্রের কারণেই আমি ওদের সুযোগও দেখি।’
যদিও এখন পর্যন্ত বহুজাতিক আসরে চূড়ান্ত সাফল্যের ছোঁয়া পায়নি বাংলাদেশ। অথচ ১৯৮১ সালে টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার ১৫ বছরের মধ্যেই বিশ্বকাপ জিতেছিল শ্রীলঙ্কা। বাংলাদেশ এই জগতে ২৩ বছর পার করে দিলেও বড় কোনো অর্জন নেই। তেমন কিছু পেতে হলে যা যা বাধ্যতামূলক, রানাতুঙ্গার চোখে এর একটি এ রকম, ‘অধিনায়ক দিয়ে হবে না। লাগবে একজন নেতা। অধিনায়ক আর নেতার মধ্যে পার্থক্য আছে কিন্তু। অধিনায়ক শুধু আজকেই জেতার কথা ভাববে। নেতা ভাববে আগামীর কথাও।’
"