ক্রীড়া ডেস্ক
সাহারা-পাড়ি দিয়ে বিশ্বকাপের মঞ্চে
নিকো উইলিয়ামস ও ইনাকি উইলিয়ামস দুজনেরই কাতার বিশ্বকাপ অভিষেক হয়েছে। মাতৃভূমি ঘানার হয়ে খেলছেন ইনাকি, নিকো খেলছেন জন্মভূমি স্পেনের হয়ে। গার্ডিয়ানের সিড লো কে দেওয়া ইনাকি উইলিয়ামসের সাক্ষাৎকার- অন্য দিনের মতোই আমরা আমাদের বিলবাওয়ের বাসায় বসে টিভি দেখছিলাম। খবরে দেখাচ্ছিল কীভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছোট ছোট নৌকায় সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আফ্রিকান শরণার্থীরা ইউরোপে আসছে। মেলিয়ার বর্ডারে কাঁটাতারের বেড়া টপকে স্পেনে ঢোকার চেষ্টা করছে।
দেখতে দেখতে হঠাৎ আমার মনে হলো, আমরা কীভাবে স্পেনে এলাম এটা আমি জানি না। মাকে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে তারপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, নাহ এখন তোমাকে বলাই যায়। বাবা-মা এবং আরো ৪০ ঘানাইয়ান নাগরিককে একটা ছাদবিহীন ট্রাকে গাদাগাদি করে বসিয়ে দিয়েছিল আদম পাচারকারীরা। ট্রাকটা ছুটছিল সাহারা মরুভূমির ভেতর দিয়ে, কেন? কারণ এখানে পুলিশি প্রহরা নেই। পাচারকারীদের কেউ তাড়া করবে না। মাঝপথেই পাচারকারীরা সবাইকে ট্রাক থেকে নামিয়ে দিল। তোমরা যা টাকা দিয়েছ তা দিয়ে এটুকুই যাওয়া যাবে। বলে তারা ট্রাক নিয়ে চলে গেল। ৪০ জন মানুষ, সাহারা মরুভূমির বুকে, খাবার নেই, পানি নেই। আমার বাবার জুতোও ছিল না। মায়ের পেটে তখন আমি।
৪০ জনের মাঝে ১১ জন পৌঁছাতে পেরেছিল স্পেনের মেলিয়া বর্ডারে। বাকিদের লাশ মরুভূমিতেই রয়ে গেছে। বর্ডারে কাঁটাতারের বেড়া টপকানো মাত্রই বাবা আর মাকে সিভিল গার্ড আটক করে। তাদের কাছে স্পেনে কাজ করার কোনো অনুমতিপত্র ছিল না, অবৈধ অভিবাসী হিসেবে তাদের ফেরত পাঠানো হবে আবার ঘানাতে। ভাগ্যের কি লীলা, হাজতে থাকা অবস্থাতেই একজন দয়ালু আইনজীবীর সঙ্গে তাদের দেখা হয়। তিনি পরামর্শ দেন বাবা-মা যেন তাদের ঘানার পাসপোর্ট আর পরিচয়পত্র ছিঁড়ে ফেলেন এবং নিজেদের লাইবেরিয়ার যুদ্ধ থেকে পলাতক শরণার্থী হিসেবে দাবি করেন। বাবা-মা সেটাই করলেন, পলিটিক্যাল এসাইলাম পেলেন এবং পেলেন স্পেনে প্রবেশাধিকার।
স্পেন সরকার বাবা-মাকে জায়গা করে দিল বাস্ক এলাকায়, পাম্পলোনাতে। সেখানে ইনাকি পারদোনেস নামে একজন চার্চের ফাদার বাবা-মণ্ডয়ের দায়িত্ব নিলেন।
তিনি এরপর আমাদের পরিবারেরই অংশ হয়ে গিয়েছিলেন। তার নামেই আমার নাম রাখা।
স্তব্ধ হয়ে সব শুনলাম আমি। এখন আমি জানি বাবা কেন খুঁড়িয়ে হাঁটেন, সাহারা মরুভূমি খালি পায়ে পার করেছেন তিনি। এখন আমি জানি, আমি কোথা থেকে এসেছি। আমি জানি, কেন আমার নাম ইনাকি। আমার যখন টানা ২৪০ ম্যাচ খেলার রেকর্ড হলো (১৭ এপ্রিল ২০১৬-এর পর থেকে বিলবাওয়ের সব ম্যাচ পুরো ৯০ মিনিট খেলেছেন ইনাকি) এর মাঝে অনেক ডাক্তার অনেক ফিজিও আমাকে পরীক্ষা করেছে। তারা বলেছেন, ইনাকি তোমার রিকভারি করার ক্ষমতা অসম্ভব রকম ভালো। এখন আমি জানি, যার মা তাকে পেটে করে সাহারা মরুভূমি হেঁটে পার করেছে সে ৯০ মিনিট মাঠে দৌড়াতে পারবে না? আলবাত পারবে!
আমার বয়স যখন দশ কি বারো, বাবা কাজের খোঁজে লন্ডনে চলে গেলেন। বাবা স্টামফোর্ড ব্রিজে টিকিট চেকার, ক্লিনার এ ধরনের কাজ করতেন আর স্টেডিয়াম থেকে খেলার ছবি দিতেন। আমি ছোট, নিকো তখন আরো ছোট। আমরা কী অত বুঝতাম? শুধু টের পেতাম সবার বাবা তাদের সঙ্গে থাকে, আমাদের বাবা থাকে খালি ছবিতে আর ফোনকলে। কতটা দুর্ভাগা আমরা!
মায়ের গল্প শুনে আমি টের পেলাম কতটা সৌভাগ্যবান আমি। এই যে বিলবাওতে জন্ম হয়েছে আমার, এ কারণে আমি এখন একজন বাস্ক। অ্যাথলেটিক বিলবাওয়ের অ্যাকাডেমি আর দলের কড়া নিয়ম, বাস্ক ছাড়া কেউ সুযোগ পাবে না। আমি আর নিকো বিলবাও অ্যাকাডেমিতে বড় হয়েছি। আমি বিলবাওয়ের প্রথম কালো খেলোয়াড়। কত বর্ণবাদী গালি সহ্য করতে হয়েছে আমাকে, নিকোকে। এখন সবাই আপন করে নিয়েছে আমাদের, ওদের মতো আমরাও একজন গর্বিত বাস্ক।
একসময় ঈশ্বরের ওপর খুব রাগ হতো, এত অবিচার কেন? পাম্পলোনাতে ফেস্টিভ্যালের সময় অনেক টুরিস্ট আসত, তারা ভালো পোশাক পরে, ভালো খাবার খায়।
"