মনিরুল ইসলাম

  ২৩ নভেম্বর, ২০২২

বাবার স্বপ্ন পূরণের সারথি ছেলে

পশ্চিম আফ্রিকার দেশ লাইবেরিয়া। যে দেশে অর্থনৈতিক দৈন্যদশা আর গৃহযুদ্ধ ছিল নিত্যসঙ্গী। মানুষের সকালের ঘুম ভাঙত বোমা, গুলিবর্ষণের আওয়াজে। সে দেশে জন্মেছিলেন বিশ্ববন্দিত ফুটবলার র্জজ উইয়াহ। পুরো নাম জর্জ টাওলন মানেহ অপং উসমান উইয়াহ। সামান্য একজন সুইচ বোর্ড টেকনিশিয়ান হিসেবে জীবন শুরু করেছিলেন তিনি। তার আগে ওঠে আসেন জরাজীর্ণ বস্তি থেকে। সে করুণ ইতিহাস হৃদয়ের অলিগলি ছুঁয়ে যাওয়ার মতোই। লাইবেরিয়ার রাজধানী মনরোবিয়ার ক্লারা টাউনের এক বস্তিতেই ১৯৬৬ সালের ১ অক্টোবর জন্মে ছিলেন উইয়াহ।

জন্মসূত্রে তিনি ছিলেন দক্ষিণ-পূর্ব লাইবেরিয়ার ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী সদস্য। বাবা উইলিয়াম টি উইয়াহ খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। পেশায় একজন মেকানিক ছিলেন। মা আন্না কোয়াই উইয়াহ ছিলেন মুসলিম ধর্মের অনুসারী। চার ভাইয়ের হিজিবিজি সংসার। কোনো মতোই টেনেটুনে চলত সংসার জীবন তাদের। একেবারেই ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ অবস্থা। এই সীমাহীন কষ্টের মাঝেই বাবা-মায়ের ছাড়াছাড়ি। তখন জীবনে নেমে আসে অমানিশার কালো ছায়া। সামনে ধুধু অনিশ্চিত ভবিতব্য। সেসময় আলোকিত জীবনের সন্ধানে বাধ্য হয়ে ছুটে যান দাদির কাছে। সেখানে স্থানীয় এক স্কুলে ভর্তি হলেন তিনি। কিন্তু ফুটবলের মোহ থাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল সারাক্ষণ। যার জন্য পড়াশোনায় মনোনিবেশ করতে পারেননি ঠিকমতো। কাঠফাটা রোদ্দুর, আর তুমুল ঝড়বৃষ্টি সবকিছু উপেক্ষা করে ফুটবলের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলে। নাওয়া-খাওয়া ভুলে ধ্যানজ্ঞান কেবল একটাই। ফুটবল আর ফুটবল। শয়নেস্বপনে শুধু ফুটবলকে ঘিরে স্বপ্নের জাল বুনে চলছিলেন। শেষমেশ এই ফুটবল তাকে দিয়েছিল যশখ্যাতি। তুলেছিল সম্মানের বেদিতে।

পরবর্তী সময়ে লাইবেরিয়ানদের কাছে কিং জর্জ খ্যাতি উপাধি পান। আফ্রিকা মহাদেশের সর্বকালের সেরা ফুটবলার জর্জ উইয়াহ। ১৯৯৫ সালে ব্যালন ডি’অর খেতাব জিতেছেন। অন্যদিকে ফিফা প্লেয়ার অব দ্য ইয়ারে ভূষিত হয়েছেন ১৯৯৫, ১৯৯৬ সালে। ক্লাব ফুটবলে পিএসজি, এসি মিলান, চেলসি, ম্যান সিটি, মার্সেইয়ের হয়ে মাঠ কাঁপিয়েছেন। মাতিয়েছেন। জিতিয়েছেন। কিন্তু জন্মভূমি লাইবেরিয়ার হয়ে ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ ফুটবল বিশ্বকাপ খেলার সৌভাগ্য হয়নি। অবশ্য ২০০২ সালে দলকে বিশ্বকাপের দোরগোড়ায় নিয়ে গিয়েছিলেন প্রায়। তবে নাইজেরিয়ার কাছে হেরে স্বপ্নের খুব কাছ থেকে মলিন বদনে ফিরে আসতে হয়েছিল তখন।

এখন সে জর্জ উইয়াহ আপাদমস্তক একজন রাজনীতিবিদ। বর্তমানে তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত লাইবেরিয়ার প্রেসিডেন্টের গুরুদায়িত্ব সামলাচ্ছেন। নিজ দেশের মানুষের মাঝে শান্তির ফিরে আনতে তিনি অপরিসীম ভূমিকা রাখছেন। এত কিছুর পরও নিশ্চয়ই তিনি একটা আক্ষেপের দহনে পড়ছেন অহর্নিশ। নিজ দেশের জার্সি গায়ে জড়িয়ে বিশ্বকাপ মঞ্চে খেলতে না পারায়।

সময়ের পরিক্রমায় তার ছেলে টিমোথি উইয়াহ এসেছে ফুটবল মাঠে। এবার বিশ্বকাপে অভিষেক হয়েছিল রাজকীয়ভাবে। পেয়েছেন অভিষেক ম্যাচে গোলের দেখাও। পূরণ করেছেন বাবার অপূর্ণ স্বপ্ন। তবে লাইবেরিয়ার হয়ে নই, নিজের জন্মভূমি যুক্তরাষ্ট্রের জার্সি গায়ে চড়িয়ে বিশ্বকাপ মঞ্চে পা রেখেছেন। ২০০০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ব্রুকলিনে জন্মগ্রহণ করেন।

বাবার স্বপ্নপূরণের দিনে জেতাতে পারেননি আট বছর পর বিশ্বকাপ খেলতে আসা যুক্তরাষ্ট্রকে। ৬৪ বছর পর বিশ্বকাপে ফেরা ওয়েলসের সঙ্গে ১-১ গোলে ড্র করেছে মার্কিনরা। দলের পরাজয়ের পরও টিমোথি এখন লাইমলাইটে। তাকে নিয়ে আলোচনার কমতি নেই।

যুক্তরাষ্ট্রের জার্সি গায়ে তিনি মোট গোল করেছিলেন ৪টি। অন্যদিকে, তার বাবা জর্জ উইয়াহ লাইবেরিয়ার হয়ে করেছিলেন ১৮টি গোল। ফুটবল জীবনে বর্ণাঢ্য সময় কাটানো জর্জ উইয়াহর ক্যারিয়ারে একমাত্র আক্ষেপ ছিল বিশ্বকাপ না খেলতে পারা। তবে, এবার বাবার অপূর্ণ স্বপ্ন ছেলে ষোলকলা পূরণ করেছে। এই দিনে ছেলের অভিষেক ম্যাচ ফিফার ভিআইপি বক্সে বসে দেখেছিলেন প্রেসিডেন্ট জর্জ উইয়াহ ও তার স্ত্রী। নিশ্চয়ই এখন জর্জের বিশ্বকাপ না খেলার দুঃখ আর পোড়াবে না। কেননা; তার ছেলে সে আক্ষেপ ঘুচিয়ে দিয়েছে বেশ।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close