মুহিতুল ইসলাম মুন্না
পণ্ডিত শিয়ালের বৈঠকখানা

এক গ্রামে এক বুদ্ধিমান শিয়াল বাস করত। তার নাম ছিল ‘পণ্ডিত শিয়াল’। শিয়ালটি খুবই চতুর আর বুদ্ধিতে কৌশলী ছিল। পাড়া-পড়শিরা তার বুদ্ধিমত্তার জন্য তাকে খুব সম্মান করত। আশপাশের বন-জঙ্গল থেকে অনেক প্রাণী তার পরামর্শ নিতে আসত। এজন্য সে তার বাসার পাশে একটা বড় গাছের নিচে বসার জায়গা বানিয়ে রেখেছিল, যা সবার কাছে পরিচিত হয়ে উঠেছিল ‘পণ্ডিত শিয়ালের বৈঠকখানা’ নামে।
প্রতিদিন বিকেলে পণ্ডিত শিয়াল সেই বৈঠকখানায় বসে থাকত, আর একে একে বনের প্রাণীরা তাদের নানা সমস্যার কথা তাকে জানাত। কেউ এসে বলত খাবারের অভাবের কথা, কেউ আবার তাদের শিকারিদের নিয়ে চিন্তা প্রকাশ করত। পণ্ডিত শিয়াল ধৈর্যসহকারে সব শোনত, তারপর সবাইকে এক এক করে তার পরামর্শ দিত। তার বুদ্ধিমত্তা ও সঠিক পরামর্শে বনের সবাই বেশ উপকৃত হত।
এক দিন বনে এক বিরাট হাতি এসে হাজির হলো। সে বেশ চিন্তিত মুখে শিয়ালের কাছে এসে বলল, ‘পণ্ডিত শিয়াল, আমি বড়ই দুশ্চিন্তায় আছি। বনের এক কোণায় আমার পানির জায়গাটি শুকিয়ে গেছে, এখন আমি কী করব?’
পণ্ডিত শিয়াল একটু চিন্তা করল, তারপর হাতিকে বলল, ‘বন্ধু হাতি, তুমি তো অনেক শক্তিশালী। বনজুড়ে অনেক জায়গায় নতুন করে খুঁড়ে পানি বের করা যেতে পারে। তুমি কিছু পশু নিয়ে একসঙ্গে চেষ্টা করলে হয়তো নতুন পানির উৎস খুঁজে পাবে।’
হাতি তার পরামর্শ শুনে আনন্দিত হলো এবং সেইমতো কাজ শুরু করল। কিছুদিনের মধ্যেই সে নতুন পানির উৎস খুঁজে পেল। বনের সব প্রাণী তখন খুশিতে নাচতে লাগল। পণ্ডিত শিয়ালের বুদ্ধি আবার সবার মাঝে তার সম্মান আরো বাড়িয়ে তুলল।
এরপর থেকে পণ্ডিত শিয়ালের বৈঠকখানায় প্রাণীদের ভিড় আরো বেড়ে গেল। আর সবাই জানত, পণ্ডিত শিয়াল ঠিক ঠিকই সমাধান বের করতে পারবে।
তারপর পণ্ডিত শিয়ালের বৈঠকখানা এতই জনপ্রিয় হয়ে উঠল যে বনের প্রায় সব প্রাণী কোনো না কোনো সমস্যার সমাধান খুঁজতে তার কাছে আসতে শুরু করল। শিয়াল বেশ খুশি মনে সবার সমস্যার সমাধান করত। কিন্তু ধীরে ধীরে শিয়াল বুঝতে পারল, কিছু প্রাণী তার বৈঠকখানায় আসার অজুহাতে শুধু গল্প-গুজব আর মজা করতে আসে, আসলে এদের কোনো সমস্যাই নেই!
এক দিন সন্ধ্যাবেলা, যখন শিয়াল তার বৈঠকখানায় বসে ছিল, তখন কুমির এসে বলল, ‘পণ্ডিত শিয়াল, আমার খুবই সমস্যা হয়েছে। নদীতে মাছের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। তুমি যদি আমাকে কিছু বুদ্ধি দাও যে কিভাবে আমি সহজে শিকার ধরতে পারি।’ শিয়াল একটু ভেবে কুমিরকে বলল, ‘তুমি যদি নদীর মাঝখানে অপেক্ষা কর, তাহলে হয়তো মাছের দল তোমার কাছে আসবে, আর তাতেই তুমি সহজে শিকার করতে পারবে।’
কুমির খুশি হয়ে চলে গেল। এরপরে খরগোশ এসে তার চটপটে স্বভাবের জন্য অন্য প্রাণীদের বিরক্তির কথা বলল। পণ্ডিত শিয়াল তাকে শান্তভাবে চলাফেরা করতে বলল। তেমনি করে একের পর এক প্রাণী তার কাছে পরামর্শ নিতে আসতেই থাকল।
কিন্তু একদিন শিয়ালের নিজেরই একটু বিশ্রামের প্রয়োজন মনে হলো। এত প্রাণীর নানা সমস্যার কথা শুনতে শুনতে তার নিজের মাথা ভার হয়ে উঠল। তাই সে ঠিক করল, কিছুদিনের জন্য সে একটু গোপন জায়গায় গিয়ে বিশ্রাম নেবে। পরদিন সকালে শিয়াল সবাইকে জানিয়ে দিল, ‘বন্ধুগণ, আমি কিছুদিনের জন্য বিশ্রাম নিতে চাই। তোমরা নিজেদের মতো করে সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা কর। আমি ফিরে আসার পর তোমাদের সাহায্য করতে আবার প্রস্তুত থাকব।’
শিয়াল কিছুদিনের জন্য জঙ্গলের গভীরে এক নির্জন জায়গায় চলে গেল, যেখানে সে নিজেই প্রকৃতির সাথে সময় কাটাতে লাগল। এতদিনের সাহায্য পেয়ে প্রাণীরা একটু একটু করে নিজেদের সমস্যার সমাধান করার চেষ্টাও করতে শিখে গেল। সবাই বুঝতে পারল, শিয়াল সবসময় সাহায্য করলেও তাদের নিজেদেরও চেষ্টা করতে হবে।
শিয়াল যখন ফিরে এল, সে খুশি হয়ে দেখল, বনের প্রাণীরা আরো আত্মবিশ্বাসী আর বুদ্ধিমান হয়ে উঠেছে। এবার পণ্ডিত শিয়াল বুঝল, তাদের আত্মনির্ভরশীল হতে সাহায্য করাই তার সবচেয়ে বড় অবদান। এরপর থেকে তার বৈঠকখানায় শুধু বড় কোনো সমস্যাই আলোচনা হত, আর সবাই নিজ দায়িত্বে নিজের সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করত।
"