ফারুক হোসেন সজীব
প্রকৃতির টানে

দাদু নিশামণির হাত ধরে হাঁটছেন ছোট একটি পার্কে। মাঝে মাঝে গাছের শরীরে হাত দিয়ে কী সব বিড়বিড় করছেন! দাদুর এমন আচরণে নিশামণি তো ভীষণ অবাক!
ভাবছে, দাদু বুঝি পাগল হয়েই গেছেন! আজকাল দাদু প্রায়ই এমন করেন একা-একা কথা বলেন। আর মিষ্টি মিষ্টি হাসেন।
আরে! দাদু এখন হো-হো হাসছেন! নিশ্চয় দাদু সত্যি সত্যিই পাগল হয়ে গেছেন! না হলে কেউ এমন করে হাসে? নিশামণি বলল, দাদু তুমি পাগলের মতো হাসছ কেন?
দাদু নিশামণির দিকে তাকিয়ে বললেন, হাসছি কী আর সাধে! ও তুমি বুঝবে না!
না, তুমি কী যেন বিড়বিড় করছিলে মনে হল, গাছের সাথে কথা বলছিলে?
গাছেরা কী কথা বলতে পারে দাদু?
দাদু হেসে বললেন, তুমি এটাও টের পেয়েছ দাদুভাই? আসলে কথা বলতে পারে কিনা জানিনা, তবে ওদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করি!
কেন কেন? যারা কথা বলতে পারে না, তাদের সাথে আবার কিসের কথা শুনি?
দাদু মিষ্টি হেসে বললেন, দেখেছ দাদুভাই, এই গাছ, প্রকৃতি, পাখি ওরাও কিন্তু আমাদের পরম বন্ধু, আপনজন। ওরা আছে বলেই তো প্রকৃতির এত রুপ! ওদের দেখলেই শরীর-মন-প্রাণ জুড়িয়ে যায়।
মনে করো এই যে, এত-এত গাছপালা কিন্তু যদি এমন হতো কোনো গাছ নেই! কোনো পাখি নেই! তাহলে কেমন হতো ভেবে দেখেছ?
আর এই যে আকাশ দেখছ, যদি এমন হতো আকাশ দিয়ে একটি পাখিও উড়ে না যেত! তাহলে শুধু-শুধু আকাশ দেখতে কী কারো ভালো লাগত?
নিশামণি বলে, না দাদু একটুও ভালো লাগত না! দাদু বললেন, ঠিক তাই! যারা আমাদের প্রকৃতিতে এত-এত অবদান রাখছে অথচ তাদের ভাষা আমরা বুঝি না! কী অদ্ভুত ব্যাপার তাই না?
নিশামণি অবাক হয়ে দাদুর দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। দাদু কী বলছে এসব!
নিশামণি বলল, আচ্ছা, দাদু তুমি কি পাখিদের সঙ্গে কথা বলো?
চেষ্টা করি দাদুভাই! এজন্যই তো প্রতিদিন সকালে যখন বেলকুনিতে তিনটি শালিক পাখি এসে বসে, অনেকক্ষণ খেলা করে! বেলকুনিতে টবের গাছগুলোর পোকা-মাকড়গুলো শালিক পাখি ধরে-ধরে খায়! তখন আমি মনে-মনে ওদের সাথে কথা বলি! তা কী কথা বলো পাখির সাথে?
এই বলি পাখি তোমার নাম কি? তুমি কি পোকা খেতে ভালোবাস?
উত্তরে কী বলে পাখি?
বলে নাম আমার শালিক পাখি! আমি পোকা খেতে ভালোবাসি!
শুনে নিশামণি! হি-হি করে হেসে ফেলল।
দাদু বললেন, তুমি হাসছ?
আসলে, এসব অনুভব করতে হয় বুঝলে?
দাদু বললেন, আচ্ছা নিশা দাদুভাই, তোমার এই সবুজ মাঠ গাছপালা এগুলো দেখতে ভালো লাগে?
হ্যাঁ, আমার তো অনেক ভালো লাগে! চারদিকে এত মানুষ! এত-এত কথা! কোলাহল আমার যেন একটুও ভালো লাগে না!
দাদু বললেন, আমারও ভালো লাগে না! কীভাবে ভালো লাগবে বলো? দিন-দিন যে আমিও তোমার মতো শিশু হয়ে যাচ্ছি। এখন তো আমার সঙ্গে কেউ মিশতেও চায় না! কথাও বলতে চায় না! সবাই নিজেদের ব্যস্ততা দেখিয়ে পাশ কেটে চলে যায়।
নিশামণি বলল, আমারও তো একই অবস্থা দাদু! আমি ছোট বলে সবাই আমাকে শুধু-শুধু ধমকায়! বলে বড়দের মাঝে তুমি কি কর? যাও-যাও পড়তে বস! সারাক্ষণ শুধু নির্দেশ আর নির্দেশ! কোনো কাজ করতে গেলেও আব্বু-আম্মু বকা-ঝকা করেন!
কেন, আমার বুঝি খেলত ইচ্ছে করে না?
দাদু বললেন, অবশ্যই তুমি খেলা করবে! কথাও বলবে, পুতুলের সাথে, পাখিদের সাথে, গাছেদের সাথে, প্রকৃতির আলো বাতাসের সাথেও কথা বলবে! দেখবে ওরা কখনো তোমাকে কষ্ট দিবে না! আর তোমারও মন খারাপ থাকবে না!
নিশামণি অবাক হয়ে বলল, ও তাই বুঝি, তাহলে তুমি আমাকে নিয়ে প্রতিদিন বিকেল হলেই এই পার্কে চলে আসবে বলো? এসে গাছেদের সাথে, পাখিদের সাথে কথা বলা শেখাবে?
ঠিক আছে শেখাব দাদুভাই? সবাই এত ব্যস্ত থাকে যে, কেউ কাউকে তো সময়ই দিতে চায় না! তারচেয়ে এই গাছপালা, পাখি, লতাপাতা অনেক ভালো বুঝেছ দাদুভাই!
দাদু বললেন, কত সুন্দর বাতাস বইছে তাই না দাদুভাই?
নিশামণি চোখ বন্ধ করে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, হ্যাঁ দাদু কী সুন্দর, নির্মল বাতাস!
নিশামণির এমন কথা শুনে দাদু খুব খুশি হয়ে মনে মনে ভাবলেন, আহা! নিশা দাদুভাই আস্তে আস্তে প্রকৃতিকে চিনতে পারছে! আজকাল ছেলে মেয়েরা তো প্রকৃতির কাছেই আসে না! সারাক্ষণ শুধু সোসাল মিডিয়া নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটায়! এতে করে কী হবে, অদূর ভবিষ্যতে এই পুরো জেনারেশনই হুমকি স্বরুপ হয়ে পড়বে! প্রকৃতির এমন অকৃত্রিম অবদান, স্বাদ, তারা এত কাছে পেয়েও চিরতরে ভুলে যাবে! দাদু নিশামণির হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে প্রকৃতির নির্মল বাতাসে খুব জোরে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন!
"