মেহেরুন ইসলাম
ইকরা ও সোনার ইলিশ
কী সুন্দর ঘন বন। চারপাশে সবুজ গাছপালা। আরো আছে নানারকম পশুপাখি। হরিণ, বানর, বাঘ, কুমির, বনমোরগ ইত্যাদি। এসব দেখে ইকরা খুব খুশি। বহুদিন পরে বাবার সঙ্গে সুন্দরবনে ঘুরতে এসেছে। বাবার অফিসে ছুটিই মেলে না। এবার অনেক কষ্টে ছুটি নিয়েছে।
সুন্দরবন ইকরাদের বাড়ির পাশেই। মোংলাবন্দরের পশুর নদীর কোল ঘেঁষেই এ সুন্দরবন। ইকরার বন ভালো লাগে। ছুটি পেলেই বাবার সঙ্গে এখানে আসে। ঘুরে ঘুরে বন্যপ্রাণীদের সঙ্গে খেলা করে। হরিণ, বানর, কুমিরের সঙ্গে তার নিবিড় বন্ধুত্ব। হরিণকে বাদাম খাওয়াতে কী যে মজা! খোসা ছাড়িয়ে ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারে। আর হরিণগুলো ছুটে এসে খায়।
বানরকেও কলা, চিপস খেতে দেয়। হরিণ কিছুটা শান্ত হলেও বানর তার দুষ্ট বন্ধু। তাই, বানরকে ভয়ও পায়। কুমির দেখে মজা পেলেও আতঙ্কে থাকে। কারণ, প্রতিবছর কুমির অনেক দুর্ঘটনা ঘটায়। পশুর নদীর পাড় থেকে ছেলে-বুড়ো ধরে ধরে খায়। এজন্য কুমিরের প্রতি ইকরার বেশখানিক আতঙ্কও কাজ করে। তবুও দূরে দাঁড়িয়ে বন্দি কুমিরগুলো দেখে। এছাড়াও, ইকরা বনের অলিগলি ঘুরে বাঘমামাও খোঁজে। কতবার যে খুঁজল কিন্তু দেখা মেলে না। তাই ইকরার মনটা খুব খারাপ হয়। মনে মনে ভাবে ‘কবে যে বাঘমামাটা দেখা দেবে।’
ইকরা সকালটা বন্যপ্রাণীদের সঙ্গে কাটায়। দুপুরে বাপ-মেয়ে মজা করে বিরিয়ানী খায়। তারপর বিকেলবেলা নদীর পাড়ে বসে। অপলক চোখে দেখতে থাকে মাছ ও পানির খেলা। তার এসব বেশ ভালোই লাগে। পশুর নদীর সব মাছই ইকরার প্রিয়। তবে বেশি প্রিয় চিংড়ি, ফাইস্যা আর ইলিশ। যদিও ইলিশের কাঁটার জন্য কিছুটা বিরক্তবোধ করে। এইতো গতকালই শস্য ইলিশ খেল। আবার বায়না ধরেছে। বাড়ি ফিরে রাতেও শস্য ইলিশ চাই তার। কিন্তু বাবার কথায় ভীষণ মন খারাপ। আজ থেকে নাকি ইলিশ ধরা নিষেধ। ইলিশের প্রজননকাল চলছে। তাই এ কদিন মাছ ধরা যাবে না।
ইকরা বিষণ্ণ মনে শুয়ে আছে। রাতে ভাতও খায়নি। মা জোর করেও খাওয়াতে পারেনি।
হঠাৎ ইকরার ঘুম ভেঙে গেল। তখন গভীর রাত। সেতো মা-বাবার পাশে ঘুমে ছিল। কিন্তু কাউকেই দেখছে না। কার ডাকে ঘুম ভাঙল তার। এদিক-ওদিক খুঁজতে লাগল। কিছুক্ষণ খোঁজার পরেই বুঝতে পারল। মৎস্য রানি তার ঘুম ভাঙিয়েছে। কিন্তু কেন? আর সে এখানে কীভাবে এলো? ইকরা কিছুই বুঝতে পারছে না। মৎস্যরানির ডাকে ইকরার ঘোর কাটলো।
ইকরামনি মন খারাপ কেন তোমার?
ইকরা কিছু বলছে না।
আমি জানি তোমার মন খারাপের কারণ।
তাহলে বলোতো দেখি।
শস্য ইলিশের জন্য মন খারাপ তোমার।
তুমি কীভাবে জানলে মৎস্যরানি?
আমি সব জানি। আরো কতকিছু জানি।
আর কী জানো তুমি?
ইকরামনি শুনবে তুমি?
শুনবো, বলো মৎস্যরানি।
তোমরা মানবজাতি খুব খারাপ। আমাদেরকে বেড়ে ওঠার আগেই খেয়ে ফেল। সঠিকভাবে বাড়তেও দাও না। এখন আমাদের প্রজননকাল। আমাদের মা ইলিশ ডিম ফুটে বাচ্চা ইলিশ জন্ম দেয়। আর তোমরা সেই বাচ্চা ইলিশগুলো ধরে খাও। সরকারি অভিযান, নিষেধাজ্ঞা কিছুই মানতে চাও না। দিনে ধরতে পারো না। কিন্তু রাতে চুরি করে ঠিকই ধরো। তুমিতো ছোটমানুষ, কতখানি আর বোঝো? তোমাদের বড় মানুষগুলোই বেশি খারাপ।
মৎস্যরানির কথা শুনে ইকরার ভীষণ খারাপ লাগছে। চোখে পানি টলমল করছে।
মৎস্যরানি, আমাকে মাফ করে দাও। আমি আর প্রজননকালে শস্য ইলিশ খেতে চাইব না। আর অন্যদেরকেও নিষেধ করব।
তুমি ছোট মানুষ। তোমার কথা কে শুনবে বল?
আমি মা-বাবাকে সঙ্গে নিয়ে সবাইকে নিষেধ করব। তুমি কোনো চিন্তা কর না মৎস্যরানি।
ইকরার কথা শুনে মৎস্যরানি খুব খুশি হল। তাকে একটি সোনার ইলিশ উপহার দিল। ইকরাও খুব খুশি হলো। খুশিমনে মৎস্যরানিকে ধন্যবাদ জানালো।
জানলা গলে আলো ছিটকে পড়েছে ইকরার চোখে। আলোর ঝলকে চোখ খুলতে কষ্ট হচ্ছে তার। তবুও মায়ের ডাকে সাড়া দিয়ে উঠতে হল।
ইকরার হাতে সোনার ইলিশ। তার মা অবাক হয়ে দেখছে।
মা, অবাক হওয়ার কিছু নাই।
আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। আমি আর যখন তখন ইলিশ খাওয়ার বায়না করব না। তাই মৎস্যরানি খুশি হয়ে আমাকে এটি উপহার দিয়েছে।
ইকরাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেল মা।
লক্ষèী মেয়ে আমার কত্ত ভালো বুঝতে শিখেছে।
হুম মা, মৎস্যরানি আরো বলেছে-
‘প্রজনন কালে আমরা
বাচ্চা ইলিশ ধরব না,
বোকার মতো ভুল করে আর
নিজের ক্ষতি করব না।’
"