আল আমিন মুহাম্মাদ
গরম পিঠা
কার্তিকে আমন পাকে। ফড়িং-পাখিরা মিষ্টি মিষ্টি রোদে খেলা করে সোনালি ঢেউয়ে। মাঝে মাঝে চাষি ভাই খেত ঘুরে দেখে আসে, কবে ধান কাটব।
সিনহা তার আব্বুর সঙ্গে ধানের খেত দেখতে এসেছে। পাকা পাকা ধানের সুগন্ধে দুই বাপ-বেটার মন খুশিতে ভরে উঠেছে। সিনহা বলল, আব্বু আমাদের ধান কাটবে কবে?
কালই ধানে পোছ দেব। বাড়ি গিয়ে কামলা ঠিক করতে হবে, চল।
সিনহা তার আব্বুর হাত ধরে বলল, হুম চলো।
চলতে চলতে সিনহা বলল, আব্বু ধান কাটা হলে এবার কিন্তু আমাকে স্কুলের সাইকেল কিনে দিতে হবে। ব্যাগটাও ছিড়ে গেছে।
সিরাজ মিয়া মুখে হাসি মেখে বলল, আচ্ছা বাবা ধান কাটা হলে সব হবে।
পরদিন ধান কাটতে সিনহাও গেল তার আব্বুর সঙ্গে। দুজন কামলা মনের সুখে গান গাচ্ছে আর ধান কাটছে। সিনহা খুব মুগ্ধ হয়ে ওদের সঙ্গে ধান কাটতে লাগল। বেলাও হয়েছে খানিক। গামছায় মুড়ে সকালে ভাত নিয়ে এসেছে সিনহার আম্মু জাহিদা বেগম। সবাই হাত-মুখ ধুয়ে আলের সবুজ পিড়েয় বসে গেল খেতে।
খাবার মুখে দিয়ে সিনহা তার আম্মুকে বলল, আম্মু উঠোনের চুলাটা ভালো করে লেপেপেুছে রেখেছ তো? কদিন পরেই কিন্তু পিঠাপুলি বানাতে হবে।
আম্মু সিনহার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, রেখেছি বাবা রেখেছি, তুমি খাও তো। আর খেয়েদেয়ে আমার সঙ্গে বাড়ি চল স্কুলে যেতে হবে। তোমার আর ধান কাটতে হবে না।
সিনহা বলল, না! না! আমি আরো কাটব।
তখন সিনহার আব্বু জাহিদা বেগমকে বলল, স্কুলে যাবার জন্য বিশ টাকা নয়, আজ আমার আব্বুকে চল্লিশ টাকা দেবে কিন্তু।
যাও বাবা স্কুলে। মাথায় খানিকটা হাত বুলালো সিরাজ।
সিনহা তার আব্বুর সঙ্গে ধানের আঁটি বোঝাই করে করে বাড়ি আনলো। মাড়াইয়ের কাজটাও করল আম্মুর সঙ্গে। গোলা ভরে ধান তুলল। এক কথায় সে অনেক খাটাখাটনি করল। এগুলো করতে সিনহার আব্বু নিষেধ করলেও সে শুনিনি। বলল, আমি গাঁয়ের ছেলে এসব না করলে কি হয়! তাছাড়া তোমাদের খাটনি দেখেলে আমার খুব মায়া হয়। আমি বড় হলে তোমাদেরকে কাজ করতে দেবো না। আমি চাকরি করব, তোমারা বসে বসে খাবা। ছেলের এমন কথায় সিরাজ মিয়া দিল ভরে ওঠে।
গোলগাল চাঁদ। সন্ধের পর আঙিনাটা জোছনায় টইটুম্বুর। ডালিম গাছের ফাঁকে ফাঁকে জোছনারা খেলছে। তার পাশেই চুলো, পিঠে বানাতে বসেছে জাহিদা বেগম। চুলোর পিঠে মাদুর পেতে বই নিয়ে বসেছে সিনহা। পিঠে খাওয়ার জন্য ব্যাকুল তার মন। কিন্তু আম্মু বলেছে, অল্প একটু দেরি করলেই হবে।
সিনহা মহানন্দে বই পড়তে শুরু করল। একটুপর হঠাৎ সাইকেলের কিড়িং কিড়িং বেজে উঠল। সিনহার আব্বু এসেছে হাট থেকে, ধান বেচতে গিয়েছিল। বই ফেলে দৌঁড়ে কাছে চলে গেল সিনহা। ব্যাগটা চুলোর পিঠে এনে সবকিছু বের করলো। সিনহার জন্য নতুন জামা-প্যান্ট, মায়ের জন্য রঙিন শাড়ি। দাদির জন্য জায়নামাজের পাটি ও তাসবিহ। বড় রুই মাছ। আর মন্ডা মিঠাই তো আছেই।
খানিক মিঠাই নিয়ে সিনহা তার দাদিকে দিয়ে আসল। সিরাজ মিয়াও হাত-মুখ ধুয়ে চুলোর কাছে গিয়ে বসল।
সিনহা মিঠাই খেতে খেতে আব্বুকে বলল, আব্বু আমার সাইকেল আর ব্যাগ কবে দেবে?
এই তো আব্বু, কালই শহরে যাব। সবকিছু দেব, কিন্তু লেখাপড়া ঠিকমতো করতে হবে যে।
সিনহা শুনে খুশিতে আটখান হয়ে গেল। বলল, আচ্ছা আব্বু। ক্লাসের ফার্স্ট বয় আমি কাউকে হতে দেব না।
ততক্ষণে পিঠা হয়ে গেল কিছু। সঙ্গে সঙ্গে জাহিদা বেগম দুই বাপ-বেটাকে এক থালে বেড়ে দিল। পিঠার সুগন্ধ সিনহার খুশি খুশি মনটাকে আরো ভরে দিল। গরম গরম পিঠা নিয়ে কী হাসিমুখে খাচ্ছে! এমন হাসিমুখ দেখে সিরাজ মিয়া ও জাহিদা বেগম যেন এই মুহূর্তে পৃথিবীর সেরা সুখী মানুষ। কিন্তু হাসিমুখের আয়নায় হঠাৎ করে ভেসে উঠল কিছু হৃদয় নিঙড়ানো স্মৃতি। গত বছর এই সময়ে এই চুলোর কাছেই বসে সিনহার মতো হাসিমুখে পিঠা খাচ্ছিল মেয়ে নুশরাত। আজ সে নেই। থাকলে সিনহার মতো সেও এ রকম হাসিমুখে পিঠা খেত। কিন্তু স্মৃতির মেঘেরা মন উঠোনের চাঁদকে মুহূর্তে আড়াল করে ফেলেছে। সিরাজ ও জাহিদা বেগমের মুখটা নিরব এক দুঃখের ছায়ায় নিমজ্জিত হলো। এমন দৃশ্য দেখে সিনহা বুঝতে পেরেছে, আব্বু-আম্মুর মনে হয় বুবুর কথা মনে পড়েছে।
সিনহা যখন গরম পিঠা মুখে দিয়েছিল, তখন তারও খুব বুবুর কথা খুব মনে পড়ছিল। খুব কষ্ট হচ্ছিল। আব্বু আম্মুকে বুবুর গরম পিঠা খাওয়ার কথাটা বলবে বলবে করে স্মৃতির জলে কিছুটা সাঁতরিয়ে আর বলতে পারিনি। না বললেও কি, আম্মুকে স্মৃতিরা ছেড়ে দেয়নি। জোছনালোকিত আঙিনাটা ঘন অন্ধকারে ঢেকে দিয়েছে।
"