বিচিত্র কুমার
ভাইফোঁটা
ভাইফোঁটার দিন ঘিরে দীপিকার মনে কী যে উচ্ছ্বাস! প্রতি বছর এই দিনটার জন্য অপেক্ষায় থাকে সে। ছোট্ট দীপু যখন মায়ের কোলে ছিল, তখন থেকেই দীপিকা তার কপালে ফোঁটা দিয়ে আসে। যদিও তখন দীপু কিছু বুঝতে পারত না, কিন্তু বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই ফোঁটা দেওয়ার বিশেষ দিনের মায়া তার মনেও দাগ কেটেছে। দীপিকার হাতের রঙিন ফোঁটা, মায়ের বানানো মিষ্টি, বাবা-মায়ের ভালোবাসা সব মিলিয়ে যেন এক আনন্দমুখর দিন।
এই বছরও ভাইফোঁটার দিন আসতেই, ঘরজুড়ে উৎসবের আমেজ। মা সকাল থেকেই মিষ্টি বানানো শুরু করেছেন। বাবাও বাজার থেকে নানা রকম মিষ্টি, ফুল, আর ফলমূল এনে রেখেছেন। আর দীপিকার তো সারা বছর ধরে পরিকল্পনা চলেছে এই দিনটাকে কীভাবে আরো সুন্দর করে তোলা যায়। কিন্তু এ বছরের দীপু যেন একটু অন্যরকম। দীপিকার প্রাণবন্ত ছোট্ট ভাইটা এদিন কেমন গম্ভীর হয়ে আছে, মুখে কোনো হাসি নেই। তার এই ভাবভঙ্গিতে দীপিকার মনের কোণে যেন একটু দুশ্চিন্তার ছায়া পড়ে।
দীপিকা কয়েকবারই চেষ্টা করেছে দীপুকে জিগ্যেস করতে। কী হয়েছে? কিন্তু পারে না। শেষমেশ সে বলেই ফেলল, ‘কী হয়েছে, দীপু? তুই এভাবে চুপচাপ বসে আছিস কেন? তোর প্রিয় ভাইফোঁটা যে আজ!’
দীপু মুখ নিচু করে ফিসফিস করে বলে, ‘কিছু না।’ দীপিকার মন কিন্তু মানে না। এমন কোনো ঘটনা নেই যেটা দীপু তার দিদিকে খুলে বলে না। তবুও আজ দীপুর মন ভার, যেন কোনো না বলা কথা আটকে আছে তার ভেতরে। দীপিকা আরেকটু কাছে গিয়ে ভাইকে জড়িয়ে ধরে জিগ্যেস করল, ‘দীপু, আমায় বল, কী হয়েছে? তোর মন খারাপ কেন?’
এবার দীপু ধীরে ধীরে বলল, ‘এই বছর বাড়ির মিষ্টি খেতে মন চাচ্ছে না।’
কথাটা শুনে দীপিকার মন ভেঙে গেল। সে বুঝতে পারল, দীপু হয়তো বাইরে থেকে আনা দামি মিষ্টির আশায় আছে। ছোটবেলায় বাবা-মা অনেকেই বাইরে থেকে মিষ্টি কিনে আনতেন। কিন্তু এই বছর মা চেয়েছিলেন সব মিষ্টি ঘরেই বানাতে, যেন মায়া-মমতার ঘ্রাণ মিষ্টির প্রতিটি টুকরোতে থাকে।
দীপিকা কিছু না বলে মায়ের কাছে যায় এবং সবটা খুলে বলে। মায়ের মনেও একটু কষ্ট হয়। তিনি দীপুকে ভালোবাসায় ডেকে বলেন, ‘বাবা, জানিস? এই ভাইফোঁটার মিষ্টি কিন্তু শুধু খাওয়ার জন্য নয়, ভালোবাসা আর আদরেরও প্রতীক। ফোঁটা দেওয়ার সময় তোদের দিদির হাতের বানানো মিষ্টি খাস, দেখবি তাতে ভালোবাসার অন্যরকম স্বাদ পাবি।’
দীপু চুপ করে মায়ের কথা শোনে। সে কিছুক্ষণ চিন্তা করে, তারপর মায়ের দিকে তাকায়। দীপিকার চোখ তখন অশ্রুসজল। এদিকে দীপু মায়ের কথা শুনে যেন বুঝতে পারে, সত্যি তো! মিষ্টির আসল স্বাদ দামের নয়, মমতার।
অবশেষে দীপু তার দিদির কাছে যায়। দীপিকা তার ভাইয়ের কপালে ফোঁটা দিয়ে বলে, ‘ভাই, তুই আমার কাছে সেরা। বাইরে থেকে আনা মিষ্টির চেয়ে এই ভালোবাসার ফোঁটা অনেক মিষ্টি।’
দীপু এবার হাসিমুখে তার বোনের হাতে বানানো মিষ্টি খায়। মিষ্টির প্রথম টুকরো মুখে দিয়েই দীপু যেন এক অন্যরকম স্বাদ পেল। এক ছোট্ট অনুভূতি তাকে আরো বড় করে তোলে। দীপিকার চোখে-মুখে খুশির ঝিলিক দেখে সে বুঝতে পারে, ভালোবাসার কোনো বিকল্প নেই। বাইরে থেকে পাওয়া দামি মিষ্টির চাইতে এই ভালোবাসামিশ্রিত মিষ্টিই এলো।
দীপিকার মুখেও হাসি ফুটে ওঠে। এই ছোট ছোট ভালোবাসার মধ্যেই লকিয়ে আছে জীবনের মিষ্টতা। সেদিন দীপু শিখল, জীবনের প্রকৃত স্বাদ দামি জিনিসে নয়, বরং ভালোবাসায়, ছোট ছোট আনন্দে। ভাইফোঁটার এই উৎসব তার জীবনের এক মিষ্টি মুহূর্ত হয়ে রইল।
"