আবু সাইদ কামাল
তপনের বাঘবন্দির গল্প
ঢাকায় চাকরি করে আরাফাত। সাপ্তাহিক ছুটিতে জেলা শহরের বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত নটা বাজে। রাতের খাবার খেয়ে সোফায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছে। পাঁচ বছররের ছোট কন্যা সারমিন তখন সুযোগ নিয়ে বাবার কোলে বসে। কনিষ্ঠা এই মেয়েটির জন্ম শহরেই। গ্রামে খুব বেশি যাওয়া হয়নি। বার কয়েক বেড়াতে গিয়েছে। কখনো বা মা-বাবার সঙ্গে এক রাত থেকেছে। কিন্তু গ্রামে যাপিত জীবনের স্বাদ নিতে পারেনি। গারো পাহাড়ের পাদদেশে ছবির মতো তাদের গ্রাম। এক সপ্তাহ পরে বাবা বাড়ি এসেছে। কত স্নেহের তৃষ্ণা নিয়ে বাবার জন্য অপেক্ষায় থাকে সারমিন। সেদিন বাবার অপেক্ষায় ঘুমুতে যায়নি। বাবার কাছে বায়না ধরে বলে, গ্রামের একটা গল্প বলো আব্বু!
-কী গল্প বলব?
-তুমি না বলতে, তোমাদের গ্রামে একসময় পাহাড় থেকে বাঘ বা হরিণ নামত।
-শোনো তাহলে, একটা বাঘের গল্প বলি। এই বলে বাবা যে গল্পটি বলেন তা হলো :
ঘটনাটা ঘটেছিল পাকিস্তান আমলে। বাবা আরাফাত তখন পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। তাদের গ্রামের উত্তরে পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়ে যে খালটি পাহাড়ি নদী মঙ্গলেশ্বরীতে নেমেছে, তার নাম আন্দাখালি। এক দিন হেমন্তের সকালে সীমান্তসংলগ্ন এই গ্রামে একটি চিতাবাঘ দেখা দেয়। আন্দাখালীর পাড়ে একটি গরুকে থাবা দেয়। গরুটি মেরে রেখে বাঘটি আর একটি বাছুর ধরে নিয়ে একটি খালপাড়ের গর্তে ঢোকে। বাঘের এমন আক্রমণে দিশাহারা গ্রামের মানুষ খারনই সীমান্ত ফাঁড়িতে ছুটে যায়।
ইপিআর বাহিনীর গর্বিত সদস্য তপন সাংমা তখন ওই ক্যাম্পে অবস্থান করছে। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের উভয় অংশের এই বাহিনীতে কুস্তিগির হিসেবে সে বেশ পরিচিত মুখ। কোনো সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানে কখনো-বা পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থান করত সে। তখন ঢাকার প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত। মাঝে মাঝে কখনো সীমান্তচৌকিতে মাস কয়েকের জন্য তাকে বদলি করা হতো। সেই ধারাবাহিকতায় খারনই সীমান্তচৌকিতে কয়েক মাসের জন্য অবস্থান করছে তপন।
সাধারণ মানুষের মুখে বাঘের ঘটনা শুনে তপন সাংমা বলে, চল তো দেখি! বাঘের এত বড় সাহস যে আমাদের দেশে ঢুকে লোকালয়ে আক্রমণ করে। বলেই সে থ্রি-কোয়ার্টার হাফপ্যান্ট পরা অবস্থায় রওনা হয়। বিশালদেহী এই পালোয়ানের গায়ে কোনো বস্ত্র নেই। তপন সাংমা রাস্তায় বের হলে উৎসুক জনতা অবাক হয়ে তাকে দেখে। গ্রামে তখন বাঘের চেয়ে যেন সে-ই অধিক দর্শনীয় হয়ে ওঠে। তার একেকটা বাহু খামের মতো। পাগুলো যেন মজবুত গাছের ধাবমান কাণ্ড। তাকে পথ তখন দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আক্রান্ত গরুর মালিক। পেছনে পেছনে যাচ্ছে গ্রামের সাধারণ মানুষ। তপন যতই সামনে এগোয়, ততই তাকে দেখার জন্য আসা মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে।
আন্দাখালীর বাঁকে বাঘটি বাছুর নিয়ে যেখানে লুকিয়েছে, সেই স্থানটি দেখানো হয় তাকে। তপন দূরে থেকে দেখতে পায় বাঘটি তার দুটি বাচ্ছাসহ উল্লাসে বাছুরটার মাংস ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে। এমন দৃশ্য দেখে তপনের সঙ্গে আসা সহকর্মীকে বলে, আমাকে ক্যাম্প থেকে তাড়াতাড়ি দুটি কম্বল আর কিছু দড়ি আইন্যা দাও! বাঘটা আমি ধরব।
এ কথা শুনে এক সহকর্মী তড়িঘড়ি ক্যাম্পে রওনা হয়। সঙ্গে যায় গ্রামের দুজন কিশোর। তারা দৌড়ে দুটি কম্বল এবং দড়ি এনে তপনের কাছে দেয়। কম্বল মেলে ধরে তপন গর্তের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। অমনি কম্বলসহ তপনকে দেখে বাঘের বাচ্চা দুটি গর্ত থেকে বেরিয়ে পাহাড়ের জঙ্গলের দিকে ছুটে যায়। আহাররত অবস্থায় বাধা হয়ে দাঁড়ানোর জন্য চিতাবাঘটি ক্ষিপ্ত হয়ে তপনের হাতে ঝুলে থাকা কম্বলে ঝাঁপ দেয়। তপন সেই অপেক্ষাতেই ছিল। জট করে তপন বাঘটিকে কম্বল দিয়ে ঝাপটে ধরে। অমনি উভয়ে ধরাশায়ী হয়।
যেন বাঘে-সিংহে লড়াই। মিনিট পনেরো শার্দূল আর পালোয়ানের মাঝে ধস্তাধস্তি চলে। এরই মাঝে তপন বাঘটিকে কম্বল দিয়ে কাবু করেই চিৎকার করে বলে, এই তাড়িতাড়ি দড়ি দাও!
সহকর্মীদের একজন অস্ত্র তাক করে থাকে, আর একজন তপনের কাছে দড়ি সরবরাহ করে। মিনিট দশের মাঝে কম্বলের দড়ি দিয়ে বেঁধে বাঘটিকে তপন সাংমা বন্দি করে ফেলে। এই খবর অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে।
ততক্ষণে হাজার লোকের ভিড় জমে যায়। সমবেত মানুষ তপন সাংমার বীরত্বের প্রশংসা করতে থাকে। খালি গায়ে নিরস্ত্র একজন মানুষের পক্ষে কম্বলে জড়িয়ে একটি চিতাবাঘকে পরাস্ত করা সাধারণ কোনো ঘটনা নয়। তপন সাংমা কর্তৃক চিতাবাঘ বন্দির এ খবর মুহূর্তে যেমন এলাকায় চাউর হয, তেমনি ওয়ারলেস মেসেজে ইপিআর বাহিনীতে ছড়ায়। বাঁশ ও কাঠের চাঙারি করে বাঘটিকে প্রথমে বিওপিতে নেওয়া হয়। তারপর বিকেলেই একটি মহিষের গাড়িতে বাঘটিতে তোলা হয়। বাঘটির পাহারায় থাকে তপন সাংমা। নেওয়া হয় দুর্গাপুরে ওদিকে জেলার বন বিভাগের সহায়তায় তড়িঘড়ি লোহার খাঁচা তৈরি হতে থাকে। দুর্গাপুরে পৌঁছালে বাঘটি তোলা হয় একটি ট্রাকে।
সেক্টর হেডকোয়ার্টারে যখন নেওয়া হয়, তখন সেই দপ্তরের সব সদস্যকে দোতলায় উঠতে বলা হয়। ততক্ষণে বাঘের জন্য লোহার খাঁচাটি আনা হয়। বীরবেশে তপন সাংমা বাঘটি নিয়ে সেক্টর হোডকোয়ার্টারে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে দোতলা থেকে শোরগোল ওঠে। উৎসুক দৃষ্টিতে সবাই দেখতে থাকে যে, নির্ভিক তপন সাংমা বন্দি বাঘের পাহারায় নির্বিকার দাঁড়িয়ে। তপনই বন্দি চিতাকে অন্য সহকর্মীদের সহায়তায় ট্রাক থেকে নামিয়ে খাঁচায় ঢোকায়। তালাবদ্ধ করে ধীরে ধীরে দড়ির বাঁধন খুলে দেয়। যেই না বাঘটিকে প্যাঁচিয়ে রাখা কম্বল সরানো হয়, অমনি এক লাফে হুংকার দিয়ে বাঘটি দাঁড়ায়। ততক্ষণে তো বাঘটিলোহার খাঁচায় বন্দি।
পরদিনই তপনসহ খাঁচাবন্দি বাঘটিকে ঢাকায় প্রাদেশিক সদর দপ্তরে নেওয়া হয়। এই বীরত্বের জন্য বাহিনীর পক্ষ থেকে বিশেষ অনুষ্ঠান করে সদর দপ্তরের সব সদস্যের উপস্থিতিতে তপন সাংমাকে পুরস্কৃত করা হয়। প্রদর্শনী শেষে বাঘটিকে সরকারি সিদ্ধান্তে চিড়িয়াখানায় হস্তান্তর করা হয়।
"