বিচিত্র কুমার
শালিকের হেমন্ত বন্ধু
হেমন্তের সকালগুলো বড় মিষ্টি। ঘাসের ওপর শিশিরের কণা ঝিলমিল করে, আর আকাশে সাদা মেঘের ভেলা আলসে ভাসে। শালিক পাখিদের তো এটাই সবচেয়ে প্রিয় সময়। হেমন্তের ঝরাপাতা, কুয়াশায় মোড়ানো সকালে শালিকের দল আনন্দে মেতে ওঠে। তবে এবারের হেমন্তে শালিকের একটি বিশেষ বন্ধু জুটেছে- ঝরাপাতার রাজকুমার, ছোট্ট হেমন্তের শিশির।
শালিক পাখিটির নাম ছিল টুনটুন। সে সব সময় দলছুট হয়ে হাওয়ায় উড়ে বেড়াত, আর কোথায় ঝরাপাতা জমছে, কোথায় কুয়াশা ঘিরে ধরছে তা দেখতে বেরিয়ে পড়ত। এক দিন এমনই এক ঝরাপাতার গাছের তলায় হঠাৎ তার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল হেমন্তের বন্ধুর। টুনটুন তখন খুবই অবাক হলো, কারণ পাতা, বাতাস আর শিশিরের ভেতরে এমন বন্ধুত্বের গল্প সে আগে কখনো শুনেনি।
হেমন্ত তাকে বলল, ‘শোনো টুনটুন, আমি তোমাকে আমার জাদুর রাজ্যের গল্প শোনাব। তুমি কি যাবে আমার সঙ্গে?’
টুনটুন খুব খুশি হয়ে বলল, ‘জাদুর রাজ্য! সেখানে তো নিশ্চয়ই অনেক মজা হবে! চলো যাই।’
তারা দুজনে উড়ে গেল হেমন্তের জাদুর রাজ্যে। সেখানে বাতাসে কুয়াশার রুপালি পর্দা টানানো, পাতাগুলো সোনালি হয়ে মাটিতে বিছানো। ঝরাপাতার ওপর দিয়ে হালকা বাতাসে টুনটুন উড়ে গেল। সে দেখে সব ফুলের গাছগুলো মৃদু মৃদু নাচছে, যেন হেমন্তের সুরে তাদের প্রাণ জুড়াচ্ছে।
তাদের সামনে এসে হাজির হলো হেমন্তের ফড়িং বাহিনী। ফড়িংদের দল টুনটুনকে দেখে আনন্দে কিচির মিচির শুরু করল। তারা সবাই মিলে শালিককে স্বাগত জানিয়ে বলল, ‘তোমাকে আমাদের হেমন্ত উৎসবে স্বাগতম!’
শালিক আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘হেমন্ত উৎসব? এ আবার কী?’
একটি বয়স্ক ফড়িং হাসি মুখে বলল, ‘এটা আমাদের বিশেষ উৎসব। আমরা হেমন্তে প্রতিবার একসঙ্গে ঝরাপাতা জড়ো করে, কুয়াশার মাঝে লুকোচুরি খেলে, আর হাওয়ায় ভাসি। হেমন্তের সঙ্গে আমরা মজা করি আর নতুন বন্ধুদের নিয়ে একসঙ্গে উৎসব করি।’
শালিক টুনটুন মুগ্ধ হয়ে দেখল ফড়িং বাহিনী কেমন আনন্দে মেতে আছে। তারা সবাই মিলে গাছের নিচে এসে বসল, তারপর ঝরাপাতার গাদায় গা এলিয়ে দিল। হেমন্ত শিশির তাদের ঘিরে হালকা বাতাসের সুর এনে দিল। টুনটুন তখন নতুন একটি গান ধরল-
‘হেমন্তের হাওয়া, ঝরাপাতার ছোঁয়া,
আমাদের সবার প্রাণ,
এটাই আমাদের গান।’
ফড়িংরা সেই গানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নাচতে লাগল। তারা নাচতে নাচতে কুয়াশার মেঘের মধ্য দিয়ে শূন্যে উড়ে গেল, আর টুনটুনও তাদের সঙ্গে ঘুরতে লাগল। ঝরাপাতা উড়ে উড়ে চারদিকে ভাসতে লাগল, আর শালিকের বন্ধুরা তাতে মেতে উঠল।
সন্ধ্যা নেমে এলো। হেমন্তের শীতল বাতাস চারপাশে ছড়িয়ে পড়তে লাগল, আর ফড়িংদের দল বিদায় জানিয়ে চলে গেল। কিন্তু টুনটুন তখনো রয়ে গেল হেমন্তের সঙ্গে। হেমন্ত শিশির তাকে বলল, ‘আজকের দিনের মতো এবার আমাদের বিদায় নিতে হবে, তবে আবার দেখা হবে। মনে রেখো, তুমি হেমন্তের বন্ধু, তুমি যখনই চাইবে আমার জাদুর রাজ্যে আসতে পারবে।’
টুনটুন খুশি মন নিয়ে বিদায় নিল। সে ফিরে গিয়ে নিজের দলের কাছে গল্প বলতে শুরু করল, হেমন্তের জাদুর রাজ্যের কথা, ঝরাপাতার সঙ্গে খেলাধুলা, আর ফড়িংদের আনন্দের উৎসব। তার গল্প শুনে অন্য শালিকরাও মুগ্ধ হয়ে গেল। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিল, পরেরবার হেমন্ত এলেই তারা আবার একসঙ্গে হেমন্তের জাদুর রাজ্যে ঘুরতে যাবে।
এভাবে টুনটুন আর তার শালিক বন্ধুরা মিলে হেমন্তের সঙ্গে প্রতি বছর আনন্দে মেতে ওঠে, কুয়াশার ভেতর দিয়ে ঝরাপাতায় খেলতে খেলতে নতুন নতুন বন্ধুত্ব গড়ে তোলে। হেমন্তের সুর, ঝরাপাতার ছোঁয়া, আর কুয়াশার আলিঙ্গনে শালিকদের প্রতিবারই মনে হয় যেন নতুন এক উৎসবের শুরু।
"