আব্দুস সালাম
বোনের আদর
অনিতার বড় বোন মালিহা। বয়সে তার চেয়ে পাঁচ বছরের বড়। বাবা চাকরি করেন আর মা গৃহিণী। ছোটবেলা থেকেই অনিতা দেখে যে তার বোন অন্ধ। স্কুলে যাওয়ার পথে আনমনে মালিহা রাস্তা পার হচ্ছিল। হঠাৎ কোথা থেকে একটা গাড়ি এসে তাতে ধাক্কা দেয়। সেই দুর্ঘটনায় তার বোন মাথা ও চোখে আঘাত পায়। তারপর থেকে ধীরে ধীরে দুচোখের দৃষ্টি কমতে থাকে। অনেক চিকিৎসার তার চোখ দুটোকে বাঁচানো যায়নি। সেই দুর্ঘটনার করুণ কাহিনি অনিতা বাবা-মায়ের কাছে অনেকবার শুনেছি। অনিতা লক্ষ করেছে তার মা যখন দুর্ঘটনা স্মৃতিচারণ করেন ঠিক কিছুক্ষণ পরই মায়ের দুই চোখ সজল হয়ে ওঠে। মা আফসোস করে বলেন, আমি যদি মেয়েটিকে সেদিন স্কুলে নিয়ে যেতাম, তাহলে হয়তো সে বেঁচে যেত। একই কথা অনিতাকে প্রায়ই শুনতে হয়। বোন চোখে না দেখলে কী হবে, বাবা-মায়ের আদরের কোনো কমতি নেই। বাবা-মা তাকে একটু বেশিই ভালোবাসে। আদর-যত্ন করে। তার সব কাজে সাহায্য করে। মা প্রায়ই অনিতাকে বলেন, ‘আপু যদি কোনো কাজে তোমাকে ডাকেন তার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনবে। তাকে সাহায্য করবে। খেয়াল রাখবে সে যেন তোমার কথায় কষ্ট না পায়।’ তবুও বোনের সব কথা অনিতার ঠিকমতো শোনা হয় না। বারবার ডাকার পর একবার সে কাছে যায়। এতে তার বোন কষ্ট পায় কি না তা সে উপলব্ধি করতে পারে না। অনিতার কারণে মালিহা যদি কখনো রাগ করে, তৎক্ষণাৎ মা অনিতাকে বকা দিয়ে মালিহাকে সান্ত¡না দেন। অবশ্য অনিতা ছোট বলে মালিহার রাগটা বেশি ক্ষণ থাকে না। এভাবেই তাদের দিনগুলো পার হয়ে যায়।
অনিতারা যে শহরে বাস করে, তার পাশ দিয়েই বয়ে গেছে ভৈরব নদী। শহরটি কেমন যেন গ্রাম দিয়ে ঘেরা। গ্রামের পরিবেশ অনিতার খুব ভালো লাগে। বাবা প্রায়ই তাকে মোটরবাইকে ঘুরতে নিয়ে যায়। কদিন আগে অনিতার স্কুল পরীক্ষা শেষ হয়েছে। পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগে বাবা বলেছিলেন পরীক্ষা শেষ তোমাকে বেড়াতে নিয়ে যাব। অনিতার পরীক্ষা শেষ হয়েছে। কিন্তু বাবা কোনোভাবেই সময় দিতে পারছে না। অফিসে কাজের চাপ থাকায় ছুটির দিনেও বাবাকে অফিসে যেতে হয়। কিন্তু বাবা আজ অনিতাকে কথা দিয়েছে বিকেলে ভৈরব নদীর পাড়ে তাকে বেড়াতে নিয়ে যাবে। বাবা বলেছে, ‘ওখানে গেলে তোমার খুব ভালো লাগবে। নদীর দুই পাড়ে সারি সারি কাশফুল। কোথাও না কোথাও দেখবে মাঠের মাঝে বসেছে সাদা সাদা বকের মেলা। গাছের ডালে মাছরাঙাদের চুপটি করে বসে থাকা, প্রজাপতিদের ওড়াউড়ি, নীল আকাশ সবই তোমাকে আনন্দ দেবে। বাবার কথাগুলো যখনই অনিতার মনে হয়, তখনই সেগুলো উপভোগ করার জন্য তার জানটা ছটফট করতে থাকে। আগেভাগেই সে জামাকাপড় পরে বাবার জন্য অপেক্ষা করছে। বিকেল হয়ে গেল তবুও বাবা আসছেন না। এঘর-সেঘর করে বেড়াচ্ছে আর মাকে উদ্দেশ্য করে বলছে, বাবা এখনো আসছে না কেন? বাবাকে এখনই ফোন দাও। এক্ষুনি আসবে বলো। মা শুধু সান্ত¡না দেয়। আর বলে একটু ধৈর্য ধরো। এখনই চলে আসবে।
মালিহা অনিতাকে কাছে ডেকে বলে, ‘তুমি রাগ করছো কেন? বাবা ভীষণ ব্যস্ত। আজ যাওয়া না হলে কালকে যাবে।’ ‘তুমি বেড়াতে যাওয়ার কী বোঝো? তুমি তো চোখে দেখো না? দেখলে বুঝতে?’ কথাগুলো বলেই সে অন্য ঘরে বালিশে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। মা তাদের কথোপকথন শুনে অনিতার কাছে গিয়ে গেলেন, ‘ছি! অনিতা ছি! তুমি আপুকে কী বললে? তুমি তো জানো, তোমার আপু আগে চোখে দেখত। তোমার মতো মালিহাকেও তোমার বাবা বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে নিয়ে যেত। সেও খুব খুশি হতো। কিন্তু সেই ঘাতক গাড়িটা আমার মেয়ের জীবন এভাবে নষ্ট করে দেবে কে জানতো। থাক এসব কথা। এখন আর তা স্মৃতিচারণ করতে চাইনি। যাও আপুর সঙ্গে গিয়ে গল্প কর।’
অনিতা তার ভুল বুঝতে পারে। সে মনে মনে বলে আপুর সঙ্গে ওভাবে কথা বলা আমার ঠিক হয়নি। সে আপুর কাছে গিয়ে বসে। মালিহা খুব খুশি হয়। ‘আপু, তুমি কী ভৈরব নদীর পাড়ে বেড়াতে গিয়েছ?’ ‘অনেকবার গিয়েছি। শুধু ভৈরব কেন? কত জায়গায় গিয়েছি।’ ‘বলো না তুমি কেমন করে মজা করতে?’ মালিহা স্মৃতিচারণ করতে থাকে...। তোমার মতো আমারও গ্রাম খুব ভালো লাগে। গ্রামের আঁকাবাঁকা পথ। পথের দুপাশে ফসলের মাঠ। সবুজ ধানখেত। নানা ফুলের সমাহার, প্রজাপতির রঙিনপাখা, পাখিদের কিচিরমিচির ডাক আমার খুব ভালো লাগে। গ্রামের অপার সৌন্দর্য, নয়নাভিরাম বৈচিত্র্য সবই আমার ভালো লাগে। একটু খেয়াল করলে দেখবা- ভিন্ন ভিন্ন ঋতুতে গ্রামের রূপের কিরূপ পরিবর্তন হয়! আমাদের গ্রামে কাজলা নদীর ওপর একটা ব্রিজ আছে। বাবা মাঝে-মাঝে আমাকে নিয়ে যেত। ব্রিজের নিজে তাকালে দেখতে পেতাম নদীর বুকে ভেসে আছে অসংখ্য শাপলা ফুল। দূর থেকে দেখা যেত জেলেরা মাছ ধরছে। তাদের মাছ ধরার দৃশ্য আমার খুব ভালো লাগে। হিমেলা হাওয়া গায়ে মাখতে আমার এখনো সাধ হয়। নীলাকাশে সাদা মেঘের পাহাড় দেখলে আমার নয়ন জুড়িয়ে যেত। আমাদের গ্রামের বাঁশঝাড়ে জোনাকির মেলা বসে। বান্ধবীদের সঙ্গে কত দিন পাল্লা দিয়ে জোনাকি পোকা ধরেছি। রাতেরবেলা ছাদের ওপর বসে রুপালি চাঁদ দেখলাম। আর আমার দাদি আমাকে গল্প শোনাত। বর্ষাকালে খাল-বিল, নদী-নালা জলে ভরে যায়। আমি কত দিন বর্ষাতে ভিজেছি। আমার না এখনো বর্ষাকালে ভিজতে খুব ইচ্ছে করে। শীতকালে সরিষার খেতগুলোকে দেখলে মনে হলুদের সাগর। আমার খুব ইচ্ছে করে সরিষার খেত ধরে দূরে কোথাও হারিয়ে যেতে। আমি জানি- আমার এ সাধ কোনোদিন পূরণ হবে না। আমার না ঘরে বসে থাকতে একদম ভালো লাগে না। মাঝে মাঝে মনে হয় আমি যদি মরে যেতাম তাহলে অন্ধত্বের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতাম।
মালিহার কথাগুলো শুনে অনিতার দুচোখ সজল হয়ে ওঠে। সে ডুকরে কেঁদে ওঠে। আপুকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘তুমি মরবে না। আমি সব সময় তোমার পাশে থাকব। মৃত্যুর কথা কক্ষনো মুখে আনবে না। আমি যেখানেই যাই তোমাকে নিয়ে যাব। তুমি আমার কথায় কষ্ট পেও না। আমাকে মাফ করে দাও’। মালিহাও ছোট বোনকে ধরে আদর করে। দুই হাত দিয়ে চোখের জল মুছে দেয় আর বলে আমি কী তোর ওপর রাগ করে থাকতে পারি? তুই না আমার আদরের ছোট বোন।
"