শাকিলা নাছরিন পাপিয়া
মায়াময় পৃথিবী
জন্মদিনে রিফাহর বান্ধবীরা এলো। আরো এলো রুফাইদার বান্ধবীরাও।
ঘরভর্তি আত্মীয়স্বজন। সবাই যার যার মতো গল্প করছে, খাবার খাচ্ছে।
শুধু রিফাহ, রুফাইদা আর রাফিদের মন খারাপ।
ওদের মন খারাপ বলে ওদের বন্ধুদেরও মন খারাপ।
এত এত খেলনা অথচ মনে তবুও কোনো আনন্দ নেই কারো।
কেন সবার মন খারাপ?
কেন? কেন? কেন?
আসলে রিফাহর ফাপুর ঘরে একটা ছোট্ট সোনামণি আসার কথা অথচ সে কিছুতেই আসছে না।
এই সোনামণিটার জন্য রিফাহ, রুফাইদা, রাফিদ আর তার বন্ধুরা কবে থেকে অপেক্ষায় আছে।
সে এলে তাকে কার কোন খেলনাটা দেবে, কে কখন কোলে নেবে, কাকে সে কী বলে ডাকবে আরো কত কী ভেবে রেখেছে সবাই মিলে।
বড়রা যখন যার যার কাজে ব্যস্ত তখন ওরা সবাই মিলে ছাদে গেল। আকাশে তখন বিশাল এক চাঁদ।
চাঁদের আলোয় ভরে গেছে চারদিক।
আকাশের দিকে তাকিয়ে রুফাইদা আর রাফিদ বলল, আল্লাহ আমাদের একটা ছোট্ট সোনামণি দাও।
রিফাহ সঙ্গে সঙ্গে বলল, প্লিজ আল্লাহ আমাদের জন্য সোনামণি পাঠাও।
রিফাহর বান্ধবী সেঁজুতি বলল, হে ভগবান, এই বাড়িতে একটা ছোট্ট সোনামণি দাও।
রুফাইদার বান্ধবী দেবী বলল, হে ঈশ্বর একটা সোনামণি রুফাইদাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দাও।
সবাই মিলে চোখ বন্ধ করে আকাশের দিকে হাত মেলে সৃষ্টিকর্তার কাছে চাইতে লাগল একটা সোনামণি।
হঠাৎ চাঁদের আলো থেকে ধীরে ধীরে বের হয়ে এলো একজন পরী।
সবাই চোখ বড়-বড় করে পরীকে বলল, তুমি কে?
পরী বলল, আমি লাল পরী।
তোমাদের কথা শুনে আমি এলাম।
ঠিক আছে তোমাদের জন্য সোনামণি দেওয়া হবে।
তবে, সোনামণি তৈরির জন্য যা যা লাগবে তা নিয়ে এসো।
সবাই তো এ কথা শুনে খুশিতে আটখানা।
এখন সোনামণি তৈরির উপকরণ আনার পালা সবার।
রিফাহ্ গেল কোকিলের কাছে।
বিনীতভাবে বলল, কোকিল আপু, আমায় তোমার মধুর গান দেবে? সোনামণির জন্য লাগবে।
কোকিল গান দিয়ে বলল, ঠিক আছে নিয়ে যাও।
কিন্তু গান তো এমনি এমনি হবে না।
গানের সঙ্গে সুর আর বাদ্যও তো লাগে।
রুফাইদা বাদ্যের জন্য গেল মন্দিরে। কাঁসা আর ঘণ্টার বাদ্য নিয়ে ফিরল সে।
রাফিদ গেল মসজিদে আজান থেকে সুর আনতে।
একটা সুমধুর গান তৈরি হলো।
এবার রং আনার পালা। একদল গেল রংধনুর কাছে। অন্যদল গেল প্রজাপতির কাছে।
প্রজাপতি দিল এক বাটি রং।
রংধনু বলল, এই নাও এক বালতি রং। সাবধানে নিয়ো।
ঝরনার কাছে গিয়ে সবাই মিলে বলল, তোমার নেচে নেচে চলা থেকে একটুখানি আমাদের সোনামণিকে দেবে?
ঝরনা বলল, সোনামণির জন্য নেবে? তবে নাও না!
আমার শুভেচ্ছা দিয়ো তাকে।
নদীর কাছে গিয়ে বলল, নদী দিদি, নদী দিদি, তোমার সারা দিন ছন্দে বয়ে যাওয়া আমাদের সোনামণির জন্য একটুখানি দাও না, প্লিজ।
নদী বলল, বেশ তো, নাও।
পাহাড়ের কাছে গিয়ে চিৎকার করে সবাই মিলে ডাকল, পাহাড় ভাইয়া! ও পাহাড় ভাইয়া!
পাহাড় বলল, ডাকছো কেন?
তুমি অবিচল দাঁড়িয়ে থাক স্থির। এই স্থিরতা আমাদের সোনামণিকে দেবে?
পাহাড় বলল, ওহ! এই খবর।
বেশ তো, নাও না।
সবাই মিলে সবকিছু নিয়ে বাড়ি ফিরে ছাদে গেল।
চিৎকার করে রাফিদ বলল, লাল পরী আমরা সবকিছু জোগাড় করে নিয়ে এসেছি।
সেঁজুতি বলল, দেখ আমরা কত কিছু এনেছি।
দেবী বলল, এবার তাড়াতাড়ি একটা সোনামণি বানিয়ে দাও।
লাল পরী সবগুলো উপকরণ নিয়ে বলল, এখনো কী যেন বাকি আছে।
ওরা বলল, রিফাহ আর রুফাইদা গেছে সূর্যের কাছে আলো আনতে। এখনো ফেরেনি তারা।
একটু অপেক্ষা কর ওরা এক্ষুনি ফিরবে।
রিফাহ আর রুফাইদা দৌড়াতে দৌড়াতে এসে হাঁপাতে লাগল।
তারা দুজন বলল, সরি একটু দেরি হয়ে গেছে। সূর্যমামা বলল, একটু অপেক্ষা করে সকালের আলো নিয়ে যাও। তাই দেরি হলো।
সকালের আলোটুকু নিয়ে লাল পরী বললেন, এবার ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে।
ছোটরা সবাই একসঙ্গে বলল, আমরা বড়দের ডেকে আনি। তুমি একটু দাঁড়াও।
বললেন, ‘না, কক্ষনো নয়। বড়রা বোকা। তাদের তোমাদের মতো বুদ্ধি নেই।’
তোমরা সবাই বুঝলে আল্লাহ, ভগবান, ঈশ্বর নানা নামে ডাকলেও তিনি এক। অথচ বড়রা কিছুই বুঝে না। তারা সৃষ্টিকর্তাকে নিয়ে ঝগড়া করে। তাই সৃষ্টিকর্তা বলেছেন, তোমাদের কথা আমায় শুনতে। বড়দের আমি দেখা দেব না।
বড়রা চাইলেও আমায় দেখতে পারবে না।
তোমরা বরং সোনামণির জন্য অপেক্ষা করো। ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করো আর সোনামণির জন্য গাছ লাগাও। যেন সে পৃথিবীতে এসে পৃথিবীটা সবুজ আর সুন্দর দেখতে পায়। সেই সঙ্গে প্রতিদিন জমিয়ে রাখো অনেক অনেক ভালোবাসা। তোমাদের সোনামণির জন্য দেশটাকে ছায়াময়, মায়াময়, আলোময় করে গড়ে তোলো।’
তারপর অপেক্ষার পালা।
বড়রা দেখে, সারা দিন ছোটরা গোপনে গোপনে নিজেদের মধ্যে কী যেন আলাপ করে, পরামর্শ করে। যেখানেই গাছ পায় এনে ছাদে লাগায়।
বন্ধুদের বাড়িতে নিয়েও গাছ দিয়ে আসে।
দেবী গ্রামে বেড়াতে গিয়ে গাছ লাগানোর বায়না ধরল।
দেবীর মা জানতে চায়, গাছ লাগিয়ে কী হবে?
দেবী মাকে বলল, ঈশ্বর সোনামণিকে পাঠাবে। লালপরী নিয়ে আসবে। লালপরী আমাদের বলেছে, সোনামণির জন্য ছায়াময়, মায়াময়, আলোময় দেশ বানাতে।
দেবীর মা বড় বড় চোখ করে বললেন, লালপরী তোমাদের এ কথা বলেছে?
-হ্যাঁ, বলেছেন তো।
-তুমি লালপরীকে দেখেছো?
-আমরা সব বন্ধুই দেখেছি।
-তোমরা সবাই দেখেছ?
-দেখেছি তো। তবে, লালপরী বলেছে, তোমরা বোকা। তাই তোমরা যারা বড়, তারা লালপরীকে দেখতে পারবে না।
-আমরা বোকা কেন?
-তোমরা আল্লাহ, ঈশ্বর, ভগবান নিয়ে ঝগড়া করো। কিন্তু আমরা তো জানি, নাম আলাদা। ডাকার ধরন আলাদা। অথচ তিনি এক।
দেবীর কথাগুলো দেবীর মা ফোন করে সেঁজুতির মাকে বললেন। সেঁজুতির মা বললেন, সেঁজুতিও তাকে একই কথা বলেছে।
রিফাহর মাও জানালেন, রিফাহ, রুফাইদা, রাফিদও একই কথা বলেছে।
সব মা তাদের ছোট ছোট সন্তানদের কাজ এবং কথায় অবাক।
দিন, মাস, বছর যায়। সোনামণি আর আসে না।
মায়েরা হাসতে হাসতে শুধায়, কি রে অনেক তো গাছ লাগানো হলো, সোনামণি কোথায়?
বিজ্ঞের মতো সবাই মিলে উত্তর দেয়, ধৈর্য ধরতে হবে। তাকে তৈরি করা হচ্ছে।
সবার মা-বাবা ওদের উত্তর শুনে হেসে ফেলে।
অবশেষে এক দিন ভোরবেলা রিফাহ তার ফাপুর ঘরে গিয়ে দেখে ফাপুর কোলের কাছে শুয়ে আছে সোনামণি। হাত পা নেড়ে নেড়ে হাসছে।
প্রথমে সে যেন বুঝতেই পারছে না, কাকে দেখছে।
যখন বুঝতে পারল এত তাদের সোনামণি, তখন আনন্দে চিৎকার করে সবাইকে ডাকতে লাগল।
রিফাহর চিৎকার শুনে ছুটে এলো সবাই।
অবাক হয়ে দেখল সোনামণিকে। সবাই একসঙ্গে জানতে চাইল, তোমার নাম কী?
সোনামণি এক লাফে বাবার কোলে গিয়ে কানে কানে কী যেন বলল।
বাবা হেসে উত্তর দিলেন, ওর নাম... ইপ্সিতা অরুণিমা।
"