সুলেখা আক্তার শান্তা
সেতুবন্ধ
রাতে প্রচণ্ড ঝড় হয়েছে। ঝড়ে সব লণ্ডভণ্ড। ভোরে সূর্য ওঠার আগে অনিকের ঘুম ভেঙে যায়। চারদিকে আলো ফুটতে শুরু করেছে। অনিক উঠে পড়ে বিছানা ছেড়ে। বাইরে বেরিয়ে দেখে বাড়ির উঠানে রাতের ঝড়ে গাছপালা উপড়ে পড়ে আছে। তার মা আবিদা সেগুলো ঠিকঠাক করার চেষ্টা করছেন। অনিক এসে মায়ের সঙ্গে হাত লাগায়। মা বলেন, তোমাকে এসব করতে হবে না। তুমি? ঘরে যাও। অনিক দেখতে পায় উঠানের কোনায় একটি পাখি পড়ে আছে। কাছে গিয়ে মনে হলো পাখিটি আঘাত পেয়েছে, তাই উড়তে পারছে না। অনিক মাকে বলে, মা দেখো কী সুন্দর পাখি কিন্তু উড়তে পারছে না। মা ছেলের ডাকে এগিয়ে গেলেন। আহা! ঝড়ে আঘাত পেয়ে পাখিটি পড়ে গেছে। অনিক বলে, মা ওকে খেতে দাও কিছু। আবিদা পাখিটিকে আলতো করে ধরে ঘরে নিয়ে যায়। অনিক বলে, মা ওকে দুধ খেতে দাও তাহলে শক্তি হবে। ঘরে দুধ ছিল একটি বাটিতে করে এগিয়ে দেয়। পাখিটি খাওয়ার কোনো আগ্রহ দেখায় না। তারপরও পাখির খাবার দিতে থাকে। ভাত, চাল, গম যাই খেতে দেওয়া হয় না কেন সে কিছুই খায় না। পাখিটিকে নিয়ে কী করা উচিত তা বুঝে উঠতে পারে না অনিক। মা বলেন ডাক্তার দেখাতে হবে। ভাগ্যক্রমে কাছেই ছিল পশু হাসপাতাল। অনিক পাখিটি নিয়ে মার সঙ্গে সেখানে যায়। ডাক্তার পরীক্ষা করে বললেন পাখিটির পা ভেঙে গেছে। পায়ে ব্যান্ডেজ করে আর কিছু ওষুধপত্র দিয়ে দেন। অনিক নিয়মিত পাখিকে যত্ন নেয়। পাখির খাবার ওষুধ পানি ঠিকমতো খাওয়ায়। নিজের খাওয়া ঠিক না থাকলেও পাখির খাওয়া ঠিক রাখে। অনিক পড়াশোনা আর পাখি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। স্কুলে যাওয়ার আগে পাখির খাবার পানি সবকিছু ঠিক করে রেখে যায়। মাকে বারবার বলে যায় দেখে রাখতে। মা হাসেন অবলা প্রাণীর প্রতি সন্তানের মমতাবোধ দেখে। স্কুলে গেলেও অনিকের মনটা পড়ে থাকে পাখির কাছে। কতক্ষণে সে বাড়ি ফিরে পাখিটিকে দেখতে পাবে। স্কুল থেকে ফিরেই পাখি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে পাখিটি পা ভালো হয়। অনিক খুব খুশি। পাখির মুখে বুলি ফুটেছে। টুম্পা, টুম্পা বলে শব্দ করে। আবিদার মনে হয় পাখিটি কারো পালিত পাখি। যে পালত তার নাম হয়তো টুম্পা ছিল।
আবিদাভাবে পাখিটির নিশ্চয় টুম্পার কথা মনে পড়ছে। এখন কই পাই তার সেই মালিককে। অনিক পাখির কাছে গিয়ে বলে, তোমাকে আমিও খুব ভালোবাসব। তোমার নাম রাখলাম মিঠু। আজ থেকে তোমাকে মিঠু বলে ডাকব। আমার নাম অনিক, আমাকে অনিক বলে ডাকবে। কিছুদিনের মধ্যে পাখিও অভ্যস্ত হয়ে যায়। অনিক, অনিক বলে ডাকতে শুরু করে। পাখির ডাক শুনে অনিক বেশ মজা পায়। কী খাওয়ালে পাখি আরো ভালো থাকবে তাই নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে। সবাই যখন পাখিটিকে মিঠু, মিঠু বলে ডাকে, সে লেজ নাড়িয়ে আনন্দ প্রকাশ করে। মিঠুকে অনেকেই দেখতে আসে, অনিকের নাম ধরে ডাকা শুনে আশ্চর্য হয়! অনিক তার বন্ধুদের গর্ব করে বলে, দেখেছো আমার পাখি আমার নাম ধরে ডাকে। সবাই বিস্মিত হয়ে মাথা নাড়ে, তাই তো! তোমার পাখি তোমার নাম ধরে ডাকে। খেলার সাথিদের কাছে মিঠুর এখন আলাদা কদর।
মিঠু হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে। তা দেখে অনিক অস্থির হয়ে যায়। মাকে বলেন, মা আমার মিঠুর এ রকম হচ্ছে কেন? বাবা অসুস্থ হলে একটু তো খারাপ লাগবেই দেখবে ঠিক হয়ে যাবে। না মা তুমি মিঠুর জন্য কিছু কর। মিঠুকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে চল। মা বলেন, বাবা হাতে তো টাকা নাই। অনিক বলে, মা তুমি তো আমাকে জামা-প্যান্ট কিনে দিতে চেয়েছিলে। আমার এগুলো লাগবে না, তুমি সেই টাকা দিয়ে ডাক্তার দেখাও। মা বলেন, পশুপাখিদের শরীর এমনি ভালো হয়ে যায়। মানুষের মতো ঘনঘন ডাক্তার দেখাতে হয় না। কদিন অপেক্ষা করে দেখ এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে। অনিক বলে, আমি বুঝি ওর খুব কষ্ট হচ্ছে। দেখছ না খাওয়া-দাওয়া একদম ছেড়ে দিয়েছে। মা মিঠুর কষ্ট দেখে আমারও কষ্ট হচ্ছে। ছেলের পাগলামি দেখে আবিদা মিঠুকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান। ডাক্তার দেখানোর পর অনিক একটু শান্ত হয় যে তার মিঠু এখন সুস্থ হয়ে যাবে। কিন্তু মিঠুর টুম্পা, টুম্পা ডাকটা বাড়তে থাকে। মিঠুর এমন অবস্থা দেখে অনিক ও তার মা বেশ চিন্তিত। তারা মিঠুকে নিয়ে আশপাশে কয়েক বাড়িতে টুম্পার খোঁজ করতে থাকে। বেশ কয়েক দিন খোঁজখবর করার পর এক বাড়িতে টুম্পার খোঁজ মেলে। মিঠুর আসল মালিক টুম্পা মিঠুকে পেয়ে খুব খুশি। মিঠুও পাখা ঝাপটে আর বেদম লাফালাফি করে তার আনন্দ প্রকাশ করে।
টুম্পা মিঠুর নাম রেখেছিল টাবু। সেই নামেই ডাকে, ও টাবু তোমাকে না কত জায়গায় খুঁজছি। কোথাও তোমার সন্ধান পাই নাই। আর তোমাকে কোথাও যেতে দেব না। টাবু আনন্দ প্রকাশ করে পাখা ঝাপটে। পাখিটি খুব খুশি তার মালিককে পেয়ে। অনিকও খুশি কিন্তু চেহারায় বিষাদের ছায়া। টুম্পা ব্যাপারটা বুঝতে পারে, ঠিক আছে টাবুকে তুমি নাও। অনিক আর তার মা বুঝতে পারে এ অবস্থায় পাখিটিকে নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। অনিককের খারাপ লাগলেও সান্ত¦না যে, মিঠু তার মালিককে পেয়েছে।
বাড়িতে আসার পরই অনিকের ভীষণ জ্বর। জ্বরের মধ্যেও বিড়বিড় করে মিঠু, মিঠু বলে ডাকছে। আমার মিঠু কই? আবিদা ছেলেকে বলেন, বাবা তুই এমন করছিস কেন? তুই তো মিঠুকে দিয়ে এলি তার মালিকের কাছে, এখন তুই এমন করছিস কেন? মা মিঠু আসবে না? মা বলেন, বাবা চলো আমি তোকে মিঠুর কাছে নিয়ে যাব। না মা, আমি মিঠুর কাছে যাব না, মিঠু যদি আমার কাছে না আসে। অনিক কিছুই খায় না। না খাওয়ায় অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছে। ছেলের এমন অবস্থা দেখে মা ঘাবড়ে যান। সান্ত¡না দিয়ে বলেন, বাবা একটু অপেক্ষা করো। রাতটা শেষ হোক আমি তোমাকে মিঠুর কাছে নিয়ে যাব। অনিক জ্বরে প্রলাপ বকে, মা আমার মিঠু আসবে না? হ্যাঁ বাবা আসবে, তোমার মিঠু আসবে। এখন তুমি একটু চোখ বন্ধ করে ঘুমাও। সকাল হতেই মিঠু এসে হাজির। আর অনিক, অনিক বলছে মিঠু। অনিক তা শুনে বিছানায় উঠে বসে। হাত বাড়িয়ে মিঠুকে আদর করে। অনিক পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠছে। তুমি আমাকে রেখে আর যাবা না মিঠু। মিঠু মাথা নাড়িয়ে বলে, না। নেচে, নেচে ডাকে অনিক, অনিক। এবার মিঠু ও অনিকের মধ্যে রচিত হলো এক নতুন সেতুবন্ধ।
"