মেহেরুন ইসলাম
জাদুর ঘুড়ি
রাফি খুব চঞ্চল একটি ছেলে। চঞ্চল হলেও পড়াশোনায় বেশ ভালো। সবার কথা না শুনলেও বড় ভাইয়ার কথা শোনে। বড় ভাইয়ার সঙ্গে তার খুব ভাব। রাফিরা দুই ভাই। ওর বড়ভাই রোহান, ভার্সিটিতে পড়ে। রোহান খুব মেধাবীও, ভার্সিটির স্যাররা ওর খুব প্রশংসা করে।
রোহান মা-বাবার বাধ্যগত সন্তান হলেও রাফি ওতটা বাধ্য নয়। সারা দিন খুব দুষ্টুমি করে। চাকরি, অফিস নিয়ে তার আব্বু সারা দিন ব্যস্ত থাকে। আব্বুর সঙ্গে কথা, দেখা খুব কমই হয়। রাফির সারা দিন যায় ভাইয়া আর আম্মুকে নিয়ে। ভাইয়ার সঙ্গে খুব ভাব তার। আম্মুর সঙ্গেও কম ভাব না। তবে সে কিছুতেই আম্মুর কাছে পড়তে চায় না। রোহান বাসায় না থাকলেও পড়ে না। একা যা পাড়ে তাই পড়ে, তবুও আম্মুর কাছে পড়ে না।
রাফি দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। গত সপ্তাহের ক্লাস টেস্টে সে অঙ্কে কম মার্কস পায়। কারণ সেদিন রোহান বাসায় ছিল না। জেদি ছেলে মায়ের কাছে পড়তেই বসেনি। রোহান বাসায় ফিরে রাফিকে বোঝায়। কিছুদিন পরই আমার ছুটি শেষ হবে, আমি ভার্সিটিতে চলে যাব। ক্লাস, কোচিং নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ব। তখন তুমি কার কাছে পড়বে? কে তোমাকে অঙ্ক বোঝাবে? রাফির মনটা খারাপ হয়ে গেল। রাফি রুম থেকে বের হয়ে যায়।
সারা বাড়ি খুঁজে কোথাও রাফিকে পাওয়া গেল না। অনেক খোঁজাখুঁজির পরে ছাদে পাওয়া গেল। ঘুড়ি হাতে ছাদের এক কর্নারে বসে আছে সে। রোহান চুপিচুপি গিয়ে পাশে বসে। ওরে বোকাছেলে! দুপুরের এমন কড়া রোদে কেউ ঘুড়ি ওড়ায়?
রাফি কিছু বলে না।
কিগো রাফিবুড়ো, অভিমানে আমার সঙ্গে কথাই বলবে না?
না, তুমি পচা। তুমি আমাকে ছেড়ে ভার্সিটিতে কেন যাবে?
ভার্সিটিতে না গেলে তোমার ভাইয়া বড় বড় বিল্ডিং বানাতে পারবে বল?
এখানে কি বিল্ডিং বানানো শেখায়?
হুম, শেখায়।
ভার্সিটিতে পড়েই তো আব্বুর মতো বড় চাকরি করা যাবে, বিল্ডিং বানানো যাবে। আরো কতকিছু!
তাহলে তোমার সঙ্গে আমাকেও ভার্সিটিতে নিয়ে চল না ভাইয়া।
হ্যাঁ, তোমাকেও নেব। তার আগে তোমাকে আরো বড় হতে হবে। বেশি বেশি বই পড়তে হবে।
আচ্ছা ভাইয়া। চল আমি এখনই বই পড়ব।
বাহ্ রে! আমার ভাইটি কত্ত ভালো! সোনার টুকরো ভাই আমার!
রাফি সব সাবজেক্ট বেশ ভালো পাড়ে। তবে অঙ্ক তার ভালো লাগে না। অঙ্কের প্রতি যত অনীহা। রোহান অনেক কৌশলে মজা করে ওকে অঙ্ক শেখায়। তাই আর বিরক্ত লাগে না।
দুই ভাই মিলে সারাবাড়ি মাতিয়ে রাখে। রোহান থাকায় তার আম্মুর কোনো চিন্তা নেই। রাফি দুষ্টুমি করলেও পড়ালেখাটা করে। সারা দিন তাকে জ্বালালেও রোহানের কথায় অন্তত বই পড়ে।
দেখতে দেখতে রোহানের ছুটি শেষ হয়ে গেল। রোহান ব্যাগপত্র গুছিয়ে ভার্সিটিতে চলে যায়। এদিকে রাফির মন খারাপ। আজকাল মনমরা হয়ে পড়ে থাকে। ঠিকমতো খায় না, এমনকি রোজকার মতো ঘুড়িও উড়ায় না। আম্মুর কথাও তেমন শোনে না। মন চাইলে পড়ে, না চাইলে পড়ে না।
রাফিকে নিয়ে তার আব্বু-আম্মু খুব টেনশনে পড়ে যায়। রাতে কিছু সময় আব্বুর কাছে পড়ে। কিন্তু তাতে সিলেবাস কভার হচ্ছে না। বেশি টেনশনে পড়ে রাফির আম্মু। টেনশনে টেনশনে সে একটা উপায় বের করে।
রাফি এখন ঘুড়ি না উড়ালেও ঘুড়িটি তার সঙ্গেই থাকে। এমনকি পড়তে বসলেও পাশে থাকে। রাফি তার আব্বুর সাহায্যে সব পড়া পারলেও পরে আর অঙ্কটা মনে থাকে না। অঙ্ক নিয়ে রাফিও টেনশনে পড়ে যায়। ইশ! আব্বু জানি কেমনে অঙ্কটা করেছিল... স্যারও কেমনে করেছিল...
ধুর কিছুই মনে থাকে না আমার, মাথাটা একদম গোবর ভরা- বলতে বলতে ঘুড়িটি হাতে নেয় রাফি। ঘুড়ি হাতে নিতেই চমকে উঠে সে।
ওমা! এ দেখি অঙ্ক করা, যেটি আমি পারছি না ঠিক সেটিই! এই ঘুড়ি, তুই কি জাদুটাদু জানিস? একদম যে ভাইয়ার মতো সহজে অঙ্কটা করে দিলি। তোকে অনেক ধন্যবাদ বন্ধু।
কী মজা! কী মজা!
কাল আমাকে আর স্যারের বকা শুনতে হবে না।
রাফির আম্মু আড়াল থেকে এসব কাণ্ড দেখে হাসে।
হোমওয়ার্ক শেষে রাফি যথারীতি নাশতা করে। আম্মুর হাতের প্রিয় পাকোড়া খেতে খেতে ছাদে ঘুড়ি ওড়ায়।
আজকাল অঙ্ক পারাতে রাফির মনও ভালো থাকে। স্কুলের বন্ধুদের বলেছে এই মজার কথা। কিন্তু কেউ বিশ্বাস করেনি। তবে তার আব্বু আর ভাইয়া বিশ্বাস করেছে। আব্বু তো বাসায় ফেরার সময় রোজ রোজ তার প্রিয় চিপস আনে। আরো বলেছে, পরীক্ষায় প্রথম হলে তাকে অনেকগুলো ঘুড়ি কিনে দেবে। আর রোহান ভাইয়া বলেছে, এবার ভার্সিটি থেকে আসার সময় তার পছন্দের চকলেট আর একটি লাল ঘুড়ি আনবে। বন্ধুরা তার মজার গল্প বিশ্বাস না করার কষ্ট সে ভুলে গেছে এই আনন্দে।
রাফির আজকাল মনটাও ফুরফুরে থাকে। সে এখন একাই অঙ্ক করতে পারে। তার মানে সে বড় হয়ে গেছে। সেও ভাইয়ার মতো ভার্সিটিতে পড়বে, বড় বড় বিল্ডিং বানাবে। ভাবতেই রাফি খুশিতে আপ্লুত হয়।
রাফিসোনা একা একা কার সঙ্গে কথা বলছো?
আম্মু আমি নিজের সঙ্গেই কথা বলছি।
নিজের সঙ্গেও কথা বলা শিখে গেছো তুমি?
হ্যাঁ, আম্মু। ভাইয়াকে বলে দিও- আমিও বড় হয়ে গেছি। কদিন পরে আমিও ভার্সিটিতে পড়ব। তারপর বিল্ডিংও বানাব।
ওরে আমার সোনাবাবা! বলেই আদরের পরশ দিল রাফির কপালে।
আজ আনন্দে আনন্দে রাফি একটা চ্যাপ্টারই শেষ করে ফেলল। তার আব্বু এসে পড়তে দেখে। আজ আমার ছেলেটা এখনো পড়ছে?
হ্যাঁ, আব্বু। তোমার আসতে লেইট হচ্ছে দেখে আমি অপেক্ষা করছি।
ওকে, বাবা। জাস্ট পাঁচ মিনিট, আমি এক্ষুনি আসছি।
পাঁচ মিনিট পরই রাফির আব্বু এলো।
আজ কয়টা অঙ্ক শেখাল তোমার ঘুড়ি?
আব্বু, আজ তো আমি একটি চ্যাপ্টার শেষ করেছি।
ওরে বাবা! তাই নাকি?
হ্যাঁ আব্বু।
অনেক তো পড়া হলো। আজ আর অঙ্ক নয়, বইটই রাখ। তোমাকে আজ একটি মজার গল্প বলব।
রাফি তো সেই খুশি। আব্বু বলো, বলো।
তোমার কী মনে হয় ঘুড়ি সত্যি অঙ্ক করতে পারে?
পারে তো। ভাইয়ার মতো সহজভাবে আমার অঙ্কগুলো করে দেয়।
আমি যদি বলি পারে না, তাহলে তুমি বিশ্বাস করবে?
না, আব্বু। আমি বিশ্বাস করব না।
তোমার ঘুড়ি অঙ্ক করে না। অঙ্কগুলো আর কেউ করে।
রাফি পুরোই অবাক হয়ে যায়। আব্বুর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
চমকে গেলে তাই তো?
আব্বু তাহলে কি ভূত এসে...
আরে বোকা, না, না।
তোমার টেবিলের পাশে জানালাটি দেখছো?
জি আব্বু।
ওখানে হাত বাড়িয়ে কেউ তোমার ঘুড়ির নিচে অঙ্ক করে রেখে যায়। এবার বলো সে কে হতে পারে?
রাফি চিন্তায় পড়ে গেল। ভাবুকের মতো মুখে হাত দিয়ে ভাবছে আর ভাবছে। আর বিড়বিড় করে বলছে- ভাইয়া ভার্সিটিতে, আব্বু অফিসে। তাহলে বাসায় কে কে? আমি, আমি, আমি। ও আর আম্মু আছে তো...। আব্বু পেয়ে গেছি, তাহলে বলো কে?
আম্মু করে রেখে যায়।
হ্যাঁ, তুমি ঠিক বলেছো।
রাফির চোখে-মুখে উচ্ছ্বাসের ঢেউ। এক হলো সে সঠিক উত্তর পেরেছে। দুই হলো তার আম্মুও এত সুন্দর অঙ্ক করতে পারে। আবার তাকে চমকও দিল।
তোমার ভাবনা-চিন্তা শেষ হলো? এবার বলো কার জাদুতে অঙ্ক পারতে তুমি?
আম্মুর জাদু, আমার আম্মুর জাদু। শুধু ভাইয়া নয়, আম্মুও সুন্দর অঙ্ক পারে। আজ থেকে আমি আম্মুর কাছে অঙ্ক করব।
রাফির আম্মু হাসতে হাসতে তার প্রিয় পাকোড়া নিয়ে এলো। রাফিও হাসতে হাসতে পাকোড়া খেতে লাগল, আব্বুকেও দিল। আর খুশিতে আম্মুকে নিজের হাতে খাইয়ে দিল। আম্মু তুমিই আমার জাদুর আম্মু। তুমিও সুন্দর অঙ্ক পারো। আজ থেকে আমি তোমার কাছে অঙ্ক শিখব।
"