নুরুল্লাহ আলম নুর

  ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

নদীর কান্না

লতা ঘুম থেকে উঠেই টের পেল ঘরের মেঝে ভিজে গেছে। রাতের বৃষ্টিতে বন্যার পানি ঘরে ঢুকে পড়েছে। চারপাশে শুধু পানির ঢেউ। মাটির ঘরটা যেন এখন রূপ নিয়েছে এক ছোট্ট নৌকায়! বাইরে তাকিয়ে দেখল, পানি ছড়িয়ে পড়েছে পুরো গ্রামে, সব যেন একাকার হয়ে গেছে। লতা আর দেরি না করেই তার ছোট্ট ভাইটিকে নিয়ে তড়িঘড়ি করে উঠে পড়ল খাটের ওপর।

লতা যতটা সম্ভব জিনিসপত্র উঁচুতে তুলে রাখার চেষ্টা করল। কিন্তু পানির স্রোত এতটাই প্রবল যে অনেক কিছুই বাঁচানো গেল না। বেশ কিছু জিনিস ভেসে গেল। স্রোতের সঙ্গে পালিয়ে গেল লতার ছোট্ট ভাইটির খেলার বলটাও। ঘরের পাশে থাকা ছোট ছোট হাঁসের বাচ্চাগুলোও কোথায় যে হারিয়ে গেল, কেউ জানে না। ভেসে গেল রান্নার হাঁড়ি-পাতিল, তেলের ডিব্বা, এমনকি ঘরের দরজাটাও। রয়ে গেল শুধু পানির স্রোতে তছনছ হওয়া জীবনযাপনের স্মৃতি।

লতা বসে বসে ভাবতে লাগল, প্রতি বছর এই পানি আসে, সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়। তারপর মানুষজন ভাঙা ঘরবাড়ি সারিয়ে আবার নতুন করে গড়ে তোলে। কিন্তু এভাবে আর কত? কত দিন এভাবে ভেসে চলবে? ভীষণ ক্লান্ত বোধ করল সে। এই জীবন কি কোনো দিন বদলাবে না? তাদের জন্য কি এই দুর্যোগের কোনো শেষ নেই?

দিনের বেলা ছোট্ট ভাইটিকে ঘুম পাড়িয়ে লতা বাইরে বসে থাকে। পানি তার পায়ের নিচ দিয়ে ধীরে ধীরে বয়ে যায়। লতার মনে পড়ে গেল তিন বছর আগের কথা, যখন সে তার বৃদ্ধ বাবা-মাকে এই দুর্যোগের সঙ্গে হারিয়ে যেতে দেখেছিল, তখন তার ছোট্ট ভাইটির বয়স ছিল মাত্র ছয় মাস। বৃদ্ধ বাবা-মায়ের জীবন থেমে গেছে, বাবা-মাকে হারিয়ে তাদের দুই ভাই-বোনের জীবন থেমে গেছে, কিন্তু বন্যার পানির স্রোত যেন থামে না। প্রতিবার যখন বন্যা আসে, লতার বুকের ভেতর সেই পুরোনো ব্যথা জেগে ওঠে।

রাতের বেলা, একা ঘরে বসে লতা শুনতে পেল নদীর গর্জন। তার মনে হলো, নদীটা যেন কাঁদছে। কাঁদছে তাদের জন্য, তাদের ভাঙা ঘরের জন্য। ‘নদী, তুই তো আমাদের বন্ধু! তুই কেন প্রতি বছর নিয়ম করেই আমাদের এত কষ্ট দিস?’ লতা যেন নদীকে প্রশ্ন করল। কিন্তু নদীর উত্তরে শুধু আরো গর্জন, আরো কান্নার আওয়াজ। মনে হলো, নদীও যেন তার নিজের অবস্থার জন্য কাঁদছে। মানুষ যেমন অসহায়, নদীও যেন তেমনই অসহায় হয়ে গিয়েছে।

ছোট্ট ভাইটিকে ঘুম পাড়িয়ে লতাও শুয়ে পড়ল। সে ভাবতে লাগল, মানুষের ভুলে তৈরি এই দুর্যোগের কাছে হয়তো নদী নিজেও অসহায়। লতা আরো ভাবল, এক দিন সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু সেই দিনটা কবে আসবে, তা নদীও জানে না। নদীর কান্নার সঙ্গে লতা নিজের চোখের পানি মুছে ফেলল, ভবিষ্যতের অপেক্ষায়। হয়তো এক দিন নদী আর মানুষ একসঙ্গে হাসবে। সেদিনের স্বপ্নেই সে বেঁচে থাকে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close