জিনিয়াস মাহমুদ
পাখির জন্য ভালোবাসা
আদিবা। ক্লাস ফোরের ছাত্রী। ফকির বাজার কিন্ডার গার্টেনে পড়ে। ছোটবেলা থেকেই পশু-পাখির প্রতি তার অন্যরকম এক ভালোবাসা কাজ করে। বিশেষ করে পাখির প্রতি। যেকোনো পাখি। যেই পাখিগুলো আমরা অবহেলার চোখে দেখি, সামনে দেখলেই দূর দূর করে তাড়িয়ে দিই, সে পাখিগুলোও তার কাছে প্রিয়। এই যেমন : কাকপাখি, চিলপাখি ইত্যাদি। আমরা মনে করে থাকি কাক, চিল- এরা শুধু আমাদের ক্ষতি করে। সুযোগ পেলেই হাঁসের ছানা, মুরগির ছানা ছোঁ মেরে নিয়ে যায়। কাক সারাক্ষণ কাণ্ডকা করে। অসহ্য লাগে। এই কাক, চিল আমাদের কত যে উপকার করে- তা যেন আমরা ভুলেই গেছি!
বাসাবাড়িতে ময়নাপাখি, টিয়েপাখি, শালিকপাখি, কবুতর- এগুলো আমরা পোষে থাকি। আদর করি। কাছে ডাকি। আমরা তাদের কাছে যাই। কথা বলি। খাবার দিই। আর কাকের কাণ্ডকা ডাক কানে আসতেই যেন ঢিল মারতে মন চায়! বিরক্ত লাগে। চিল দেখলেও তাই করি। কিন্তু আদিবা কোনো পাখিকেই ছোট করে দেখে না। সব পাখিকে ভালোবাসে। আদর করে। কাছে ডাকে। খাবার দেয়। অসুস্থ কোনো পাখি রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখলে- বাড়িতে নিয়ে আসে। সেবা করে। সুস্থ হলে পরে আবার ছেড়ে দেয়। পাখির জন্য আদিবা মায়ের কাছে কত যে বকা খেয়েছে, হিসাব নেই। ভাইয়াও বকে।
দুদিন পর আদিবার বার্ষিক পরীক্ষা। তাই পড়ার চাপ একটু বেশি। বিকালবেলা। আদিবা পড়তে বসেছে। হঠাৎ ঘরের চালে ধপাস করে একটা শব্দ হয়। আদিবা ঘর থেকে সঙ্গে সঙ্গেই বাইরে আসে। চালের দিকে তাকিয়ে দেখে একটি কাক ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে নিচের দিকে পড়ছে। মনে হয় কাকের গায়ে কেউ ঢিল মেরেছে। কাকটি মাটিতে পড়ার আগেই আদিবা দুহাত দিয়ে ধরে ফেলে। তারপর কাকটিকে মাটিতে রাখে।
আদিবা খেয়াল করে দেখে কাকটি তার দুটি ডানার একটি নাড়াতে পারছে, আরেকটি ঠিকমতো নাড়াতে পারছে না। কষ্ট হচ্ছে। যার ফলে সে উড়তে গিয়ে পড়ে যায়। আদিবা কাকের ডানাটি মেসেজ করতে থাকে। কিছুক্ষণ মেসেজ করার পর কাককে পানি খেতে দেয়। কাকটি মন-ভরে পানি খায়। এরই মাঝে আদিবার মা এসে তার পেছনে দাঁড়ায়। আদিবা মায়ের উপস্থিতি টের পেয়ে কাকটিকে সেখানে রেখেই চুপচাপ ঘরের দিকে পা বাড়ায়। সে জানে, এখন ঘরে না গেলে মা তাকে বকা দেবে। মা এসব একদমই পছন্দ করে না। আদিবা যখন মায়ের ভয়ে ঘরের দিকে পা বাড়ায়, তখন মা রাগান্বিত হয়ে তাকে ধমকের সুরে বলে, কাকটিকে দূরে কোথাও রেখে এসে যেন তাড়াতাড়ি পড়তে বসে। আদিবা তাই করে। তবে খুব বেশি দূরে রাখেনি। শুধু মায়ের চোখের আড়ালে রেখে আসে। যাতে করে সে কাকের খোঁজখবর নিতে পারে। সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত খাবার দিয়ে আসতে পারে। আদিবা কাকটি রেখে এসে সাবান দিয়ে ভালোভাবে হাত-মুখ ধুয়ে আবারও পড়তে বসে।
বাড়ির পেছনে তাদের যে ধানখেতটি আছে, সে খেতের ধানগাছে পোকা ধরেছে। আদিবা সকালবেলা তার মা আর ভাইয়াকে হাত ধরে টেনে খেতের কাছে নিয়ে যায়। কোনো কথা না বলে হাত তুলে সামনের দিকে ইশারা করে। সারা খেতে অসংখ্য পাখি ওড়াউড়ি করছে আর পোকা ধরে ধরে খাচ্ছে, যা দেখে মা আর ভাইয়া খুব খুশি হয়।
মা বলে, ‘খেতে বিষ দেওয়ার পরও যে পোকা মরেনি, সেই পোকা এখন পাখিরা খাচ্ছে। ভালোই হলো।’
‘হ্যাঁ, মা। পাখিরা বরং আমাদের উপকারই করছে।’ আদিবার ভাইয়া বলে।
মা আর ভাইয়ার মুখে পাখির প্রশংসা শুনে আদিবার মুখে হাসি ফোটে।
এরপর তারা খেতের চারপাশ ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকে। হঠাৎ তাদের নাকে আসে দুর্গন্ধ! আশপাশে নিশ্চয় কিছু মরে পচে আছে, যা থেকে এই দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। তিনজনই নাক ধরে ধরে হাঁটছে। এমন সময় কোত্থেকে একটা চিল এসে বাতর থেকে কী যেন ছোঁ মেরে নিয়ে উড়ে যায়। একটি কাক পাশের আরেকটি বাতরে বসে মরা ইঁদুরের মতো কী যেন ঠোকরিয়ে ঠোকরিয়ে খাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর কাকটিও তা নিয়ে উড়াল দেয়। এখন আর দুর্গন্ধ আসছে না।
এবার আদিবা তার মাকে বলে, ‘দেখেছো মা, ছোট ছোট এই পাখিরা কীটপতঙ্গ খেয়ে আমাদের ফসলগুলো রক্ষা করছে। কাকপাখি, চিলপাখি- তারাও চারপাশের ময়লা-আবর্জনা খেয়ে আমাদের পরিবেশ সুন্দর রাখছে। দুর্গন্ধ থেকে আমরা রেহাই পাচ্ছি। পাখিরা অনেক ভালো, মা। তারা আমাদের পরিবেশের অনেক উপকার করে।’
আদিবার কথা শোনে মা যেন কিছুটা লজ্জাবোধ করে। ‘ছোট্ট একটা মেয়ে, কীভাবে পাখিদের উপকারের কথা বলছে! আর আমি মা হয়েও তা এত দিন বোঝেও না-বোঝার মতো মেয়েটাকে কতই-না বকাঝকা করেছি।’ এসব ভাবতে ভাবতে আদিবাকে মা বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে। আদর করে। ভাইয়াও আদুরে-ভঙ্গিতে আদিবার মাথায় হাত বোলায়। এরপর থেকে আদিবাকে মা আর বকা দেয় না। ভাইয়াও কিছু বলে না। তারাও এখন পাখিদের ভালোবাসে। আদর করে। খাবার দেয়। অসুস্থ পাখি দেখলে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে।
"