সাগর আহমেদ
রাজকন্যা ও জাদুর লাঠি
অনেক অনেক দিন আগের কথা। ইংল্যান্ডের নটিংহ্যাম শায়ার জুড়ে ছিল এক রাজ্য। সেই রাজ্যের রাজা ছিলেন চার্লস হেউড। তিনি ছিলেন সৎ, সহজ, সরল ও নিরহংকারী। রাজা চার্লস তার প্রজাদের খুব ভালোবাসতেন। প্রজারাও তাকে খুব সম্মান করত, ভালোবাসত। তার রাজ্যটি খুব বড় ছিল না। নটিংহ্যাম শায়ার ও পাশের শেড়উড বন নিয়ে ছিল তার রাজত্ব। রাজা চার্লস হেউড খুব ভালো মানুষ হলেও তার সেনাপতি রবার্ট হেনটা খুব লোভী ছিল। সে সুযোগ বুঝে এক দিন ভোর সকালে রাজা চার্লস হেউডকে বন্দি করে নিজেকে রাজা ঘোষণা করল। রাজার একমাত্র তরুণী কন্যা লিয়া হেউডকে বন্দি করার জন্য নতুন রাজার সৈন্যরা খুঁজতে লাগল।
লিয়া তার গভর্নেস ক্যাথরিনের সহযোগিতায় রাজপ্রাসাদ থেকে পালিয়ে একাকী কাঁদতে কাঁদতে শেড়উড বনের ভেতর দিয়ে চলল। পথ চলতে চলতে তার একসময় খুব খিদে পেয়ে গেল। সে ক্ষুধার্ত হয়ে এদিক-ওদিক খাবারের সন্ধানে তাকাতে লাগল আর কাঁদতে লাগল। কিছুক্ষণ পর তার চোখে পড়ল একটা কুঁড়েঘর। সে কুঁড়েঘরের দরজায় করাঘাত করতেই একটা মেঘের মতো সাদা চুলওয়ালা বুড়ি দরজা খুলে দিল। বুড়ি খনখনে গলায় বলল, ‘ও মেয়ে, তুমি কাঁদছো কেন? কী চাও আমার কাছে?’ রাজকন্যা লিয়া বলল, ‘আমি খুব ক্ষুধার্ত বুড়ি মা, আমাকে কিছু খেতে দাও।’ বুড়ি বলল, ‘আমি তো এমনি এমনি কাউকে কিছু দিই না বাপু, খাবার পেতে হলে আমাকে অনেকগুলো কাজ করে দিতে হবে।’ লিয়া বলল, ‘ঠিক আছে বুড়ি মা, তোমার কাজগুলো দাও, করে দিই। তারপরই না হয় খাবার দিয়ো।’ বুড়ি তখন তাকে থালাবাসন ধোয়া, পানি আনা, ঘর মোছা ইত্যাদি অনেক কাজ ধরিয়ে দিল। কিন্তু কাজ শেষে বুড়ি তাকে অনেকগুলো রুটি আর গাজরের হালুয়া দিল। এত খাবার দেখে রাজকন্যা লিয়া অনেক খুশি হয়ে হলো। সে অর্ধেক খাবার তক্ষুণি খেয়ে, বাকি খাবারটা রাতের জন্য নিয়ে বুড়িকে অনেক অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে আবার বনের পথে বেরিয়ে পড়ল।
কিছু দূর যাওয়ার পর একটা শেয়াল তাকে দেখে দৌড়ে এলো। শেয়ালটা খুব চালাক আর লোভী ছিল। সে খক খক করে কেশে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি রাজকন্যা লিয়া না? তোমার বাবা খুব ভালো মানুষ ছিলেন। একবার ভালুকের হাত থেকে তিনি আমাকে বাঁচিয়ে ছিলেন। তাই তোমাকে আমি খাব না। কিন্তু তোমার হাতের সাদা রুটি আর গাজরের হালুয়া তো আমাকে দিয়ে যেতে হবে। আমি খুব ক্ষুধার্ত।’ এ কথা বলেই শেয়াল তার হাত থেকে খাবারগুলো কেড়ে নিল। রাজকন্যা লিয়া তখন মনে দুঃখ নিয়ে সামনে এগোতে লাগল। পথেই তার বুড়ির সঙ্গে আবার দেখা হয়ে গেল। বুড়ি বাজার করে ঘরে ফিরছিল। সে বুড়িকে সব কথা খুলে বলল। বুড়ি বলল, ‘ঠিক আছে বাছা, আজ রাতটা তুমি আমার সঙ্গেই থাকো। কাল আবার আমার কাজ করে দিয়ে খাবার-দাবার নিয়ে তারপর যেও।’ রাজকন্যা লিয়া বুড়ির কথায় রাজি হয়ে সেখানেই থেকে গেল। পরের দিন বুড়ির কাজগুলো করে দিতেই বুড়ি তাকে আগের দিনের মতো অনেকগুলো রুটি আর গাজরের হালুয়া দিল। সঙ্গে একটা পেল্লাই আকারের লাঠি দিয়ে বলল, ‘বাছা, এই লাঠিটি সাধারণ লাঠি নয়, এটা জাদুর লাঠি। কেউ তোমার খাবার কেড়ে নিতে এলে বা আক্রমণ করতে এলে অথবা কাউকে শাস্তি দিতে হলে তুমি শুধু বলবে-
‘ওই লাঠি উঠে পড়,
শুরু কর মারধর।’
তাহলেই লাঠি তার খেলা দেখিয়ে দেবে আর তুমি বিপদ থেকে বেঁচে যাবে।’
রাজকন্যা লিয়া বুড়িকে অনেক অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে আবার পথ চলতে শুরু করল। কিছু দূর যেতেই লিয়া দেখল এক শিকারি তার চারটে কুকুর নিয়ে একটা সিংহকে তাড়া করেছে। কুকুরগুলো সিংহটাকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলায় সিংহটি জীবন রক্ষার্থে বাধ্য হয়ে একটা সিডার গাছে চড়েছে। আর শিকারিটি তাই চাইছিল?। সিংহটা গাছে উঠতেই সে একটা তীর ছুড়ে সিংহটাকে মেরে ফেলল। তারপর ধনুকটা নামিয়ে সে মৃত সিংহটার কাছে যেতেই তার চোখ পড়ল রাজকন্যা লিয়া আর ওর খাবারগুলোর ওপর। শিকারি লোকটি খুব ক্ষুধার্ত ছিল। সে দৌড়ে এসে রাজকন্যার হাত থেকে খাবারগুলো কেড়ে নিতে চাইল, তার কুকুরগুলোও ঘেউ ঘেউ করতে করতে তার পিছু পিছু এলো। রাজকন্যা লিয়া খুব অসহায় বোধ করল। এমন সময় তার মনে পড়ল বুড়ির দেওয়া লাঠিটার কথা। সে চিৎকার করে উঠল-
‘ওই লাঠি উঠে পড়,
শুরু কর মারধর।’
আর সঙ্গে সঙ্গে লাঠিটা শিকারি ও তার কুকুরগুলোকে আচ্ছামতো পিটাতে লাগল। মারের চোটে শিকারি আর তার কুকুরগুলো কোনোক্রমে দৌড়ে পালাল। তখন শিকারির ফেলে যাওয়া ধনুক ও তীরগুলো রাজকন্যা লিয়া কুড়িয়ে নিল। পথে খিদে লাগলে সে এই তীর, ধনুক দিয়ে হরিণ শিকার করে, তারপর আগুনে ঝলসে খেয়ে নিত। রাজকন্যা লিয়ার উদ্দেশ্য ছিল শেড়উড বন পেরিয়ে পাশের রাজ্য ইয়র্ক শ্যায়ারে আশ্রয় নেওয়া। এরপর যেতে যেতে সে একদিন শেড়উড বন পেরিয়ে ইয়র্ক শ্যায়ারে ঢুকে পড়ল। ইয়র্ক শ্যায়ার রাজ্যটা শুরু হয়েছে ইয়র্ক শ্যায়ার বন দিয়ে। বেশ অনেক দূর যাওয়ার পর রাজকন্যার চোখে পড়ল একটা চকলেটের তৈরি সুন্দর রাজ প্রাসাদ। নানা রঙের, নানা স্বাদের চকলেট দিয়ে তৈরি এই প্রাসাদ থেকে দারুন খুশবু ভেসে আসছে।
রাজকন্যা লিয়া তাড়াতাড়ি রাজপ্রাসাদের ভেতরে প্রবেশ করে। দেখে একটা সুন্দর সিংহাসনে একজন খুব সুন্দর রাজপুত্র বসে আছে। কিন্তু তার পেট থেকে পা পর্যন্ত চকলেটের তৈরি। রাজকন্যা লিয়া রাজপুত্রের কাছে জানতে চাইল তার এ অবস্থা কে করল? রাজপুত্র বলল, ‘আমি ইয়র্ক শ্যায়ারের রাজপুত্র। নাম জ্যাক ফ্রান্সিস। এক দুষ্ট ভূত আমার পিতা-মাতাকে হত্যা করে, জনগণকে বনের পশুপাখি বানিয়ে এই রাজ্য দখল করেছে। সে মায়া বলে আমার শরীরের অর্ধেক আর এই পুরো রাজপ্রাসাদকে চকলেট বানিয়ে ফেলেছে। প্রতি রাতেই সে ফিরে এসে ওই চাবুকটা দিয়ে মেরে মেরে আমাকে অত্যাচার করে।’ রাজকন্যা লিয়া বলল, ‘বটে! আজ আসুক তবে।’ এরপর রাত একটু গভীর হতেই ভূতটি অদ্ভুত সবুজ রঙের আলো ছড়িয়ে রাজপ্রাসাদে এলো। আর যায় কোথায়, রাজকন্যা লিয়া লাঠির দিকে তাকিয়ে মন্ত্র পড়ল-
‘ওই লাঠি উঠে পড়,
শুরু কর মারধর।’
লাঠি তখন ভূতটাকে বেদম পিটুনি দিল। মার খেয়ে ভূতটি চেঁচাতে লাগল আর তাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য রাজকন্যার কাছে কাকুতি-মিনতি করতে লাগল। রাজকন্যা বলল, ‘ছেড়ে দিতে পারি, কিন্তু আমার শর্ত পূরণের পর। তুই রাজপুত্র জ্যাক ফ্রান্সিসকে সুস্থ, স্বাভাবিক মানুষ করে দে, আর দেশের জনগণকে পশুপাখি থেকে আবার মানুষ বানিয়ে দে।’ ভূতটা সঙ্গে সঙ্গে তাই করল আর রাজ্য ছেড়ে পালাল। রাজপুত্র জ্যাক আর রাজকন্যা লিয়া পরস্পরকে আগেই ভালোবেসে ফেলেছিল। এবার ইয়র্ক শ্যায়ার রাজ্য পুনরুদ্ধারের পর ধুমধাম করে তাদের বিয়ে হয়ে গেল। কদিন পর রাজপুত্র জ্যাক আর রাজকন্যা লিয়া বিরাট সেনাবাহিনী নিয়ে নটিংহ্যাম শায়ার রাজ্য থেকে
দুষ্ট রাজা রবার্ট হেনটাকে উৎখাতের জন্য রওনা
দিল। রবার্ট হেনটা দুষ্ট হলেও খুব চালাক ছিল। রাজকন্যা লিয়ার জাদুর লাঠির কথা সে আগেই শুনেছিল। বেধড়ক পিটানি আর কে খেতে চায়? রবার্ট হেনটা তাই রাজ্য ছেড়ে পালাল। তারপর লিয়া আর জ্যাক রাজা চার্লস হেউডকে কারাগার থেকে মুক্ত করে আবার সিংহাসনে বসিয়ে দিল?। রাজা অনেক দিন তার মেয়ে ও মেয়ের জামাইকে নিজের কাছে রাখলেন। তারপর এক দিন শুভক্ষণ দেখে জ্যাক ও লিয়া ইয়র্ক শ্যায়ারে ফিরে এসে সুখে শান্তিতে তাদের রাজ্য পরিচালনা করতে লাগল। আর গল্পটাও ফুরিয়ে গেল।
"