কনক কুমার প্রামাণিক

  ০৩ আগস্ট, ২০২৪

রাক্ষুসে বোয়াল

শিল্পীর ক্যানভাসে আঁকা ছবির মতো অনিন্দ্যসুন্দর সোনাপুর গ্রামখানি। সবুজ শ্যামলের বৈচিত্র্যে ভরা সৌন্দর্য মন কাড়ে সবার। আর দশটা গ্রামের চেয়ে সোনাপুর যেন একটু বেশিই সুন্দর। গ্রামের একপাশ দিয়ে বয়ে গেছে ছোট্ট বোয়ালমারী নদী, যা গ্রামের নৈসর্গিক রূপকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। সত্যিই এ যেন কল্পনার এক স্বর্গরাজ্য। এখানকার পরিবেশের মতো মানুষগুলোও খুব ভালো। সবার মাঝে রয়েছে মধুর একটা সম্পর্ক। ঝগড়াঝাঁটি নেই, নেই কলহ কিংবা ভেদাভেদ। যুগ যুগ ধরে এখানে হিন্দু-মুসলমান সবাই একসঙ্গে সম্প্রীতির সঙ্গে বসবাস করে আসছে। নামের মতো সোনাপুর গ্রামটির প্রতিটি পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে সোনা। বর্ষাকালে বোয়ালমারী নদীতে প্রচুর মাছ আসে। গ্রামবাসী তখন মহোৎসবে একযোগে মাছ ধরতে নেমে পড়ে নদীতে।

অনেককাল আগের কথা। একবার প্রলয়ংকরী বন্যায় বোয়ালমারী নদীর দুপাশের গ্রামগুলো প্লাবিত হয়। ডুবে যায় পুকুর-পুষ্করণী, রাস্তাঘাট আর ফসলের মাঠ। সে বন্যার জল সরতে প্রায় আট-দশ দিনের মতো সময় লেগেছিল। সেবার গ্রাম খাদ্যাভাব দেখা দেয়। কিন্তু ওরা একে অপরের সহযোগিতায় কিছুদিনের মধ্যে তা কাটিয়ে উঠে। কিন্তু বিপত্তি বাঁধে অন্য জায়গায়। বন্যার জলে গ্রামের বড় পুকুরে ঢুকে পড়ে বিশাল দৈত্যাকৃতি এক বোয়াল মাছ। তারপর সে পুকুরের অন্য মাছগুলোকে খেতে শুরু করে। এক পর্যায়ে সে মাছ শূন্য করে ফেলে জলাশয়টি। খেয়ে খেয়ে সে ক্রমেই দানবের আকার ধারণ করে। রাতের বেলা পুকুরের পানিতে মহাতান্ডব শুরু করে।

আস্তে আস্তে গ্রামের লোকজনদের মধ্যে প্রচন্ড ভীতির সৃষ্টি হয়। একদিন পুকুরের মালিক জেলেদের ডেকে এনে মাছ ধরার জন্য পুকুরে জালের টান দেয়। কিন্তু হায় কপাল! তাতে কোনো মাছ ওঠে না। জেলেরা পুকুরে পরপর তিন তিনবার টান দেয়। কিন্তু একই অবস্থা। জালে কোনো মাছ উঠে না। পুকুরের মালিক খুব নিরাশ হয়ে পড়েন। কপালে হাত দিয়ে পুকুরপাড়ে বসে পড়েন। খবরটা খুব তাড়াতাড়ি চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। লোকজন এসে পুকুর পাড়ে ভিড় করে নানাজনে নানা কথা বলতে থাকে। বয়স্ক যারা ছিল তাদের মধ্যে অনেকেই বললেন, এ নিশ্চয় মেছো ভূতের কাজ। সে নিশ্চয় রাত-বিরাতে মাছগুলো সাবাড় করে দিয়েছে। এদিকে পুকুরে যতবার জালের টান দেওয়া হয় ধূর্ত বোয়াল মাছটি পুকুরের এককোণে ঝোপের আড়ালে ঘাপটি মেরে থাকে। তাই সে আর জেলেদের জালে ধরা পড়ে না। জেলেরাও নিরাশ হয়ে সেদিনের মতো চলে যায়। পুকুরটি এক রকম ভুতুরে পুকুরে পরিণত হয়। রাত-বিরাতে আর কেউ ওদিকে যায় না। ছোট ছেলেমেয়েরা পুকুরে স্নান করতে নামলে পা কামড়ে ঘা করে দেয়। ভয়ে এখন আর কেউ পুকুরেও নামে না। সব মাছ শেষ হয়ে যাওয়ায় রাক্ষুসে বোয়ালটা পুকুরের নামা হাঁস, পাখি আর বকদের কৌশলে ধরে খেতে শুরু করে। সাধারণ গ্রামবাসীর মধ্যে আতঙ্ক আরো বেড়ে যায়। শান্তির এ গ্রামটিতে অশান্তির ছোঁয়া লেগে যায়। সবার মনে আতঙ্ক। কপালে চিন্তার ভাঁজ। কী করা যায়? ভাবতে ভাবতেই সময় চলে যায়। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত। এ ভাবনা যেন শেষই হয় না।

ঈদের কয়েক দিন আগে সন্ধ্যাবেলা কাজী বাড়ির রহমত কাজী শহর থেকে গ্রামে আসেন পরিবারের সঙ্গে ঈদ করতে। অনেকটা পথ আসতে তার দীর্ঘ সময় লেগে যায়। পুকুরের কাছে এসে শান বাঁধানো ঘাটের কাছে এগিয়ে যান হাত মুখ ধোয়ার জন্য। জলে পা দিতে না দিতেই তুমুল বেগে তার দিকে তেড়ে আসে ক্ষুধার্ত রাক্ষুসে সে বোয়াল মাছটি। দ্রুত তিনি সরে যান সেখান থেকে। সরতে সরতে তবুও দাঁতের আঁচড় লেগে যায় তার পায়ে। খানিকটা রক্তও বের হয়। অল্পের জন্য রক্ষা পান রহমত কাজী। অনেক দিন কোনো কিছু খেতে না পেয়ে সে আরো আক্রমণাত্মক হয়ে গেছে। রহমত কাজী বোয়ালটিকে ভালো মতোই দেখতে পান। অনেক দিন পর সে গ্রামে ফিরছিল। তাই গ্রামে এত কিছু ঘটে গেছে সে কিছুই জানে না। এখনকার মতো সে সময় তো কারো হাতে মোবাইল ফোন ছিল না। তাই তিনি কিছু জানতে পারেনি। রাতে গ্রামে বিরাট বৈঠক বসে। ছোট-বড় সব লোক সেখানে আসে। রহমত কাজী সবিস্তারে সবকিছু বর্ণনা করেন। সবকিছু শুনে সবার চোখ কপালে ওঠে। সিদ্ধান্ত হলো, এই বোয়ালকে সাধারণভাবে ধরা যাবে না। পুকুর শুকাতে হবে। যেই কথা সেই কাজ।

পরদিন সকালে পুকুরের চার কোনায় চারটি শ্যালো বসানো হয়। ফলে দ্রুত জলে শুকিয়ে আসে। দুপুর নাগাদ দৈত্যকার বোয়াল মাছটি সবার নজরে আসে। শুরু হয় তার তুমুল ছটফটানি। কাদার মধ্যে তার দাপাদাপিতে মনে হচ্ছিল যেন সাইক্লোন বয়ে যাচ্ছে। দুপুরের পরপরই সম্পূর্ণ পুকুরের জল শুকিয়ে যায়। প্রথমে পুকুর মালিক লম্বা এক লাঠি হাতে নেমে পড়লেন পুকুরে। তারপর ক্রোধান্বিত হয়ে লাঠির কয়েকটা ঘা বসিয়ে দিলেন বোয়ালটার মাথায়। নিস্তেজ হয়ে পড়ে মাছটা। তুমুল উল্লাস ধ্বনিতে ফেটে পড়ে সমস্ত পুকুর পাড়। এত বিশাল ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়ে যায়। তারপর পনেরো-বিশজন লোক পুকুরে নেমে মাছটিকে তুলে গ্রামে নিয়ে যায়। এত বিশাল আকৃতির বোয়াল মাছ যে এতগুলো লোক মিলে নিয়ে যেতেও হিমশিম খেয়ে যাচ্ছিল। তারপর মাঝরাত অবধি চলে সে বোয়াল মাছ দিয়ে খানাপিনার মহা-আয়োজন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close