পঞ্চানন মল্লিক
খোকার রেইনকোট
খোকাদের অভাবের সংসার। বাবা-মা দুজনই দিনমজুরি করে যা উপার্জন করে, তাতে কোনো রকমে চলে যায় সংসার। খোকার বয়স ৭ বছর। এবার দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। খোকাদের স্কুল বাড়ি থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে। দেখতে দেখতে বর্ষাকাল এসে গেল। তাই খোকার মনে দুশ্চিন্তা বর্ষাকালে সে স্কুলে যাওয়া-আসা করবে কী করে। খোকা দেখেছে ইতিমধ্যে তার স্কুলের সহপাঠী অনেকেই রেইনকোট, ছাতা ইত্যাদি পরে ও মাথায় দিয়ে স্কুলে যাওয়া-আসা শুরু করেছে। তবে এর মধ্যে রেইনকোট খোকার অনেক পছন্দের। কিন্তু পছন্দ হলে কী হবে, একটা রেইনকোটের দাম প্রায় এক-দেড় হাজার টাকা। খোকার বন্ধু রিসান সেদিন রেইনকোট পরে স্কুলে এসেছিল। রিসানের রেইনকোটটি হাতে ধরে খোকা দাম জিজ্ঞাসা করতেই রিসান জানিয়েছিল দেড় হাজার টাকা দিয়ে তার আব্বু এনে দিয়েছেন। রিসানের আব্বু বড় ব্যবসায়ী, অনেক টাকাপয়সার মালিক। তাই আগেভাগে ছেলের জন্য একটা রেইনকোট কিনে দিয়েছেন। রিসানের রেইনকোটটি দেখতে অনেক সুন্দর।
এ রকম একটা সুন্দর রেইনকোট বাবাকে কিনে দিতে বলার ইচ্ছা হয় খোকার। কিন্তু অভাবেব সংসার, তাই বলতে ইতস্তত করে সে। কিন্তু বৃষ্টি যেভাবে শুরু হয়েছে। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে কত দিন আর স্কুলে যাওয়া যায়। তাই এক দিন বিকেলে আব্বু কাজ থেকে ফিরে এলে খোকা তার ইচ্ছার কথাটা আব্বুকে বলেই ফেলল। আব্বু শুনে বলল, ‘বুঝিরে বাবা, কিন্তু তোকে একটা রেইনকোট কিনে দেব সেই সামর্থ্য যে এই মূহূর্তে আমার নেই।’ কথা শুনে খোকার আম্মু কাছে এসে বলল, ‘ভেবো না খোকার আব্বু। দরকার হলে আমার পোষা ছাগলটা এবার বেচে দেব। আর সেই টাকা দিয়ে খোকাকে একটা রেইনকোট কিনে এনে দিও।’ তারপর শনিবার হাটের দিনে ছাগলটি বিক্রি করে খোকার জন্য একটা রেইনকোট কিনে নিয়ে এলো খোকার আব্বু। রেইনকোটটি পেয়ে খোকা অনেক আনন্দিত। প্রথমবারের মতো ছেলেটাকে একটা রেইনকোট কিনে দিতে পেরে খোকার মা-বাবা দুজনের মুখেই খুশির রেখা ফঁটে উঠল।
পরদিন রবিবার সকালে খুব একটা বেশি বৃষ্টি ছিল না। তবু রেইনকোট পরে স্কুলে গেল খোকা। খোকার রেইনকোটটি দেখে স্কুলের শিক্ষকসহ সহপাঠীরা খুব প্রশংসা করল। খোকাদের স্কুলে ক্লাস শুরু হয় সকাল ৯টায়, আর শেষ হয় দুপুর ১২টায়। খোকা যখন স্কুলে গিয়েছিল, তখন বৃষ্টি তেমন না থাকলেও আস্তে আস্তে বৃষ্টির পরিমাণ বাড়তে লাগল এবং ক্লাস শেষ হওয়ার পরও মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। ক্লাস শেষে রেইনকোট পরে খোকা বের হতে যাবে, এমন সময় দেখল তার বন্ধু রিসান আর তার মা বারান্দায় সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন। কিন্তু খোকা অবাক হলো দেখে যে, রিসানের মায়ের গায়ে রেইনকোট থাকলেও রিসানের গা খালি, কোনো রেইনকোট তার গায়ে নেই। খোকা জিজ্ঞাসা করতেই রিসান উত্তর দিল, আজ সে বাসা থেকে আসার সময় ভুল করে রেইনকোট ব্যাগে তুলতে ভুলে গিয়েছে, তাই এখন তাকে ভিজতে ভিজতেই বাসায় ফিরতে হবে। শুনে খোকার মনে অনেক দুঃখ হলো রিসানের জন্য। ও বড়লোকের ছেলে। এভাবে ভেজার অভ্যাস তার নেই। কদিন পরে স্কুলে পরীক্ষা শুরু হবে। এখন এভাবে ভিজলে রিসানের জ্বর হতে পারে। তাতে তার পড়াশোনার অনেক ক্ষতি হবে!
এসব ভেবে রিসানের মাকে খোকা বলল, ‘আন্টি, রিসানের এভাবে ভেজার অভ্যাস নেই। ভিজলে রিসানের জ্বর হতে পারে। তাই একটা অনুরোধ, আন্টি আমি আমার রেইনকোটটি রিসানকে দিচ্ছি। ওকে পরিয়ে নিয়ে বাসায় যান।’ শুনে আন্টি বললেন, ‘না না বাবা ওটা তুমি পরে যাও’, কিন্তু শেষমেশ খোকার পীড়াপীড়িতে রেইনকোটটি পরতে বাধ্য হলো রিসান। আর রেইনকোটটি বন্ধু রিসানকে দিয়ে গায়ের জামা খুলে তাতে বই-খাতা জড়িয়ে নিয়ে বাইরে ছুটে বের হয়ে গেল খোকা।
পরদিন সকালবেলা রিসান রেইনকোটটি ফেরত দেওয়ার জন্য খোকার বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হলো। কারণ রেইনকোটটি ফেরত না দিলে হয়তো আজও স্কুলে যাওয়ার সময় ভিজতে হবে খোকার। তাই সে কথা ভেবে খুব সকালেই বের হলো। কিন্তু বাড়ি থেকে বের হয়ে কিছুদূর যাওয়ার পর প্রচণ্ড বৃষ্টি শুরু হলো। সঙ্গে প্রচণ্ড বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। বাধ্য হয়ে রিসান তাই পথে একটা দোকানে আশ্রয় নিল। ওখানে কেটে গেল প্রায় আধা ঘণ্টা সময়। তারপর বৃষ্টি একটু কমলে দ্রুত গিয়ে হাজির হলো খোকাদের বাড়িতে। খোকাদের উঠানে গিয়ে রিসান ডাক দিল, ‘খোকা দ্যাখ আমি তোর রেইনকোট দিতে এসেছি। কিন্তু পথে বৃষ্টির জন্য একটু দেরি হয়ে গেল।’ কিন্তু কয়েকবার ডাকার পরও খোকা সাড়া দিচ্ছে না দেখে রিসান খোকাদের ঘরের ভেতর উঠে গেল। দেখল কাঁথামুড়ি দিয়ে খোকা শুয়ে আছে। ‘কী হয়েছে তোর?’ রিসান জিজ্ঞাসা করতে খোকা আধো আধো কণ্ঠে উত্তর দিল, ‘কালরাত থেকে গায়ে অনেক জ্বর উঠেছে রে।’ রিসানের কণ্ঠ শুনে খোকার মা এগিয়ে এসে বলল, ‘বসো বাবা। খোকার গায়ে কাল থেকে অনেক জ্বর, তাই হয়তো আজও স্কুলে যেতে পারবে না বাবা।’
"