তারিকুল ইসলাম সুমন
বাবার গল্প

একটু সুযোগ পেলেই হলো। মায়ের চোখে ফাঁকি দিয়ে মোবাইল নিয়ে বসে যায় সাকিব। সোজা এসে সোফার ওপর ধপাস করে শুয়ে পড়ে। আজকাল ভিডিও গেম খেলার নেশায় পেয়েছে খুব। বাবার নিষেধ, মোবাইলে গেম খেলা যাবে না। তবু কিছুই যেন বুঝতে চায় না সে। সাকিবের বয়স এবার আট বছর। জাহানাবাদ ইংলিশ স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ছে সে।
আজ ছুটির দিন। সন্ধ্যা থেকেই বাইরে ছিল বাবা। বাবা ঘরে ঢুকতেই চোখ পড়ল সাকিবের ওপর। সাকিব তখন গেম খেলছে ঠাস ঠাস ঠাস... গুলির আওয়াজ হচ্ছে ডিস ডিস ডিস...। বাবা চিৎকার দিয়ে উঠল, দাঁড়াও তোমার গেম খেলা আমি বের করছি। মোবাইল সোফার ওপর ফেলেই দৌড় দিল সাকিব। এক ছুটে মাঝের রুম পার হয়ে সোজা দাদুর কাছে। দাদু তখন পান সাজাচ্ছে।
সাকিবের বাবা আর এদিকটায় এলেন না। দাদুর সঙ্গে গল্প জমে উঠল সাকিবের। সামান্য একটু গেম খেলতে দিলে কী এমন হয়? বাবাকে নিয়ে যত অভিযোগ ইনিয়ে-বিনিয়ে দাদুর কাছে বলছিল সে। বাবা শুধু এত্ত এত্ত বই পড়তে বলেন। এটা মোটেও ভালো লাগে না তার। দাদুর পাকা চুল টানতে টানতে দাদুর কাছে জানতে চাইল সে,
- আচ্ছা দাদু, তোমার বাবা তোমাকে কেমন আদর করত?
- খু-উ-ব। হেসে জবাব দিলেন দাদু।
- আমার মতো এত্ত এত্ত বই পড়তে? দুই হাত মেলে দেখাল সে।
- আমাদের সময় কি আর অত বইটই ছিল! বাবা আমাকে খুব ভোরে ঘুম থেকে ডেকে দিতেন, আমি মক্তবে যেতাম। আবদুল ওহাব ওস্তাদজির কাছে সুর করে করে আমপারা-সিপারা পড়তাম। এক দিন সন্ধ্যায় গৌরম্ভার হাট থেকে বাবা ফিরলেন বাড়ি। তখনকার দিনে বেতির তৈরি ধামা পাত্রে বাজার-সদায় করত সবাই। বাবা মাথা থেকে ধামা নামিয়ে আমার হাতে তুলে দিলেন একখানা কালো রঙের শ্লেট ও বক মার্কা এক বক্স চক। তার কয়েক দিন পর তো বাবার হাত ধরে পাঠশালায় ভর্তি হলাম। খুব দুষ্টুমি করতাম আমি। পুকুরের পানিতে ঝাঁপ দিতাম। পাকুড়গাছের ডাল থেকে লাফিয়ে পড়তাম খালে। নালুয়া নদীর তীরে ডাংগুলি, আর হরেনদের ভিটায় হাডুডু খেলতাম। মাঝে মাঝে পশুর নদীর চর থেকে বাবা আমাকে নিয়ে আসতেন বাড়ি। তোমরা কি আর অতসব বুঝবে দাদু! বুঝবে না। এক বুক দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন দাদু।
- আচ্ছা দাদু ডাংগুলি খেলা কী? দাদুর চোখের দিকে তাকায় সাকিব।
- হা হা হা। খুব মজার এক খেলা দাদু ভাই। বাবা আমাকে ডাংগুলি খেলা খেলতে দিতে চাইত না। দুটি লাঠি দিয়ে তৈরি করা হতো ছাওকাঠি ও বুড়োকাঠি। বুড়োকাঠি দিয়ে ছাওকাঠিকে কে আঘাত করে পাঠিয়ে দেওয়া হতো দূরে। যে যত দূরে পাঠাবে সে তত ভালো খেলোয়াড়। অবশ্য আরো কিছু নিয়মকানুন আছে ওখানে। ছোটকাঠি ছুটে অন্য কারো চোখেমুখে লাগতে পারে এটাই ছিল বাবার ভয়। আমার বাবা খুব মেজাজি মানুষ ছিলেন। হঠাৎ করে রেগে যেতেন কিন্তু মনটা ছিল খুব নরম। খুব সহজ-সরল ছিলেন তিনি। একবার বুড়ির ভিটা থেকে ভাতশালিকের ছানা এনেছিলাম। খুব বকেছিলেন বাবা। আমার হাত দিয়ে পাখির ছানা আবার নারকেলগাছের খোড়লে রেখে আসতে হয়েছিল। পশু-পাখিদের খুব ভালোবাসতেন বাবা। বুড়ির ভিটার গাছে মাটির পাত্র বেঁধে রাখতেন পাখিরা বাস করবে বলে। আহ, সেই সোনালি দিনগুলো!
- দাদু নদী কোথায়? গ্রামে গেলাম নদী তো দেখিনি!
- যে পিচঢালা রাস্তার ওপর দিয়ে গ্রামে গিয়েছিলে, ওখানে তখন নদী ছিল। এখন যেটা খালের মতো দেখা যায়, ওটাই ছিল গভীর নদী। কলকল ছলছল বয়ে চলা নদী। বাবার হাত ধরে ইলিশ মাছ কিনতে যেতাম ঘাটে। নৌকার ভেতর থেকে নড়তে থাকা ইলিশ হাতে তুলে দিতেন জেলে। হাঁকডাকে ঘাট মাতিয়ে রাখত কাসেম মাঝি। আমরা দল বেঁধে নদীর চরে ছোট ছোট গর্ত থেকে ডগরা মাছ ধরতাম। জোয়ারে নদী ভরত ঘোলা পানিতে, তবু আমরা সাঁতার কাটতাম। বাবা প্রায়ই কুমিরের ভয় দেখাতেন, কে শোনে কার কথা! বেশিক্ষণ পানিতে থেকে থেকে আমাদের চোখ লাল হয়ে যেত।
- আচ্ছা দাদু, বাবাকে নিয়ে তুমি নাকি সুন্দরবন গিয়েছিলে, খুব কাছ থেকে বনের বাঘ দেখেছো! ঘুমে চোখ প্রায় ছোট হয়ে এলো সাকিবের। হাই তুলে দাদুকে জড়িয়ে ধরল সে।
- হ্যাঁ গিয়েছিলাম তো, এখনো খুব যেতে ইচ্ছে করে। সেবারই তোমার বাবাকে প্রথম নিয়ে গিয়েছিলাম বনে। দল বেঁধে ট্রলার নেমে দুবলার চরে খুব আনন্দ করলাম। ছোট্ট এক খালের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় দেখি ডোরাকাটা বাঘ আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আমরা ভয়ে লাঠি উঁচিয়ে চিৎকার করলাম, ওটা তখনো আমাদের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল। আমি ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে কয়েকবার সুন্দরবনে গিয়েছি। একবার হয়েছে কি, ট্রলার থেকে কয়েকজন নেমে সুন্দর একটি হরিণ শিকার করে আনল। বাবা তো রেগমেগে একেবারে অস্থির। খুব বকলেন ওদের।
সুন্দরবনের হরিণ খুব ভালোবাসতেন বাবা। ঝড়-জলোচ্ছ্ব¡াস হলে কি কষ্টটাই না পায় হরিণগুলো। সমুদ্রের পানি বেড়ে গেলে কত যে হরিণ মারা যায়! ভেবে খুব কষ্ট পেতেন বাবা। বাবা বলতেন, আমার সাধ্য ও সুযোগ থাকলে সুন্দরবনের মাঝে অনেক উঁচু উঁচু স্থান করে দিতাম। বাবার মতো আমিও সুন্দরবনকে খুব ভালোবাসি। এই বন আজও আমাদের বুক পেতে আগলে রাখে। বড় সব ঝড় থেকে আমাদের বাঁচায়। বড় হয়ে তুমিও এই বনকে ভালোবাসবে। বুঝেছো দাদু?
সাকিবের সাড়াশব্দ না পেয়ে উঠে বসল দাদু। গল্প শুনতে শুনতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে সে। ঠিক আছে, এসব না হয় পরে বলা যাবে। বাবার ভয়ে তার কাছে এসেছিল সাকিব কিন্তু ঘুম ভাঙলেই তো আবার বাবাকেই খুঁজবে। লম্বা স্বরে সাকিবের বাবার ছেলের নাম ধরে ডাক দিল দাদু।
"