সা’দ সাইফ
বোধ

পল্টন মোড়ে বেশ কিছু সময় জ্যামে আটকে আছি। রিকশাওয়ালা মামার দিকে যতই তাকাচ্ছি ততই অবাক হচ্ছি। সামনের গাড়িগুলো একটু একটু করে সামনে এগোচ্ছে, রিকশার প্যাডেলও সেই গাড়িগুলোকে অনুসরণ করে চলেছে।
সংকীর্ণ জায়গা একটু একটু করে নিজের দখলে নিচ্ছে রিকশাওয়ালা। কীভাবে নিচ্ছে সেটা আমার কাছে বোধগম্য হচ্ছে না। বরং আমাকে প্রতিনিয়ত অবাক করে দিচ্ছে।
প্রতিবারই থেমে থেমে তার প্যাডেলে পা ঘোরানো দেখে বেশ খারাপও লাগছে আমার। আমি যতটা না ভারী আমার সঙ্গের মালগুলো তার চেয়ে বেশি ভারী। কীভাবে পারছে সে? মাথা ক্যালকুলেট করার চেষ্টা করছে।
হয়তো এই নিয়মে অভ্যস্ত তারা। ঢাকায় নতুন হওয়ার সুবাদে এ রকম খারাপ লাগছে হয়তো।
পল্টন মোড় পার হয়ে বায়তুল মোকাররম মসজিদ পর্যন্ত আসতে প্রায় চল্লিশ মিনিট লেগে গেল; জ্যামের দৌরাত্ম্যে।
আমার নিত্যকার অভ্যাসের মতো রিকশাওয়ালা মামার সঙ্গে আলাপ জমানোর চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু মনে হলো আলাপ বেশিদূর এগোবে না।
কারণটা অজ্ঞাত।
সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো, এটা আমার নিজের শহর যশোর না। ঢাকা।
সবার বাতচিত এক রকম হবে না। তাই বোবা হয়ে থাকার চেষ্টা করলাম।
হোটেল ভিক্টোরির সামনে থেকে বংশাল ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি এরিয়া পর্যন্ত আসার জন্য পঞ্চাশ টাকা চুক্তি করেছি; অবশ্য চার-পাঁচজন রিকশাওয়ালার কেউই রাজি হয়নি এই টাকার চুক্তিতে।
কিন্তু আমিও নিরুপায়।
আমাকে অফিস থেকে বলা হয়েছে নির্দিষ্ট অ্যামাউন্ট খরচ করতে। অগত্যা আমাকে সেটা মেনে নিতেই হবে। তাই রিকশাওয়ালার সঙ্গে জোরাজুরি করে পঞ্চাশ টাকা ও আমি জয়ী হলাম।
এদিকে আকাশটা মেঘাচ্ছন্ন; সঙ্গে বৃষ্টির কারণে অরক্ষিত মাল। বৃষ্টি এলে সেটা ভিজে যেতে পারে।
ঢাকায় নতুন। বৃষ্টি এলে জ্যামে থাকাকালে আমার করণীয় কী হবে এমন ভাবনায় রিকশাওয়ালা মামার কাছে আবার প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম।
- ‘মামা, বৃষ্টি আসতে পারে কি?’
আমার নিজ অঞ্চলপ্রীতি ভেঙে রিকশাওয়ালার উত্তর,
- ‘মনে অয় অইবো না!’
- ‘কীভাবে বুঝলেন?’
- ‘মনডায় কইলো।’
মামার উত্তরের সঙ্গে সঙ্গে সামনের গাড়িগুলো জ্যামের সঙ্গে বিচ্ছেদ করে সামনে চলতে শুরু করল। আমি আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ বসে রইলাম। আর দেখতে লাগলাম ঢাকার বিচিত্রতা।
‘নরসিংদী-মাধবদী-বি.বাড়িয়া’ ট্রান্সপোর্টে পৌঁছাতেই এজেন্সির কর্মীগুলো মালামাল রিকশা থেকে নামিয়ে নিল। ততক্ষণে সময় বলছে এক ঘণ্টা পার হয়ে গেছে রিকশার ওপর আছি।
আমি টাকা বের করার সময় রিকশাওয়ালা মামার ঘর্মাক্ত মুখ ও শরীরের দিকে নজর গেল। এক ঘণ্টার ওপর তার রাস্তার সঙ্গে সংগ্রাম দেখে পঞ্চাশ টাকা কোনোভাবেই তাকে দেওয়ার কথা মনে চাইল না। নিজেকে রিকশাওয়ালা মামার জায়গায় কল্পনা করলাম। মনে হলো, পঞ্চাশ টাকায় এই শ্রম কি আমি কখনো বিক্রি করতাম?
সম্ভবত করতাম না। অফিশিয়াল খরচ বাদে ব্যক্তিগত আরো পঞ্চাশ টাকা মামার হাতে গুঁজে দিলাম। ওই মুহূর্তে নিজেকে বেশ ভাগ্যবান মনে হচ্ছিল। কারণ, মামার ঘর্মাক্ত মুখটা অপূর্ব একটা হাসিতে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল যেন। হাসিতেই কৃতজ্ঞতাবোধের ছায়া দেখলাম স্পষ্ট।
এই হাসি লাখ টাকা দিয়েও কেনা যায় না।
রিকশাওয়ালা মামা সিগন্যাল ক্রস করে চলে যেতে লাগল আরো কোনো যাত্রীর খোঁজে। জীবিকার তাগিদে। আমি পলকহীন চোখে তাকিয়ে রইলাম সেদিকে।
একসময় মিলিয়ে গেল দৃশ্যটা...।
"