গাজী আরিফ মান্নান

  ২৭ মে, ২০২৩

মামার বাড়ি রসের হাঁড়ি

কয়েক দিন পরই জিতুর স্কুলে গ্রীষ্মকালীন বন্ধ শুরু হবে। এবারও ছুটিতে মামার বাড়িতে বেড়াতে যাবে মা-বাবার সঙ্গে। সেই মোতাবেক অনেক পরিকল্পনা করে রেখেছে। মামার বাড়িতে বেড়াতে তার খুব ভালো লাগে। এমনিতেই ঈদের ছুটিতে শুধু গ্রামের বাড়িতে যাওয়া হয়, ছুটি কম থাকে বিধায় খুব বেশি দিন থাকা হয় না, তাই আর কোথাও যাওয়ার সুযোগ হয় না। শুধু গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেলে তবেই বেশি দিন বেড়ানোর সুযোগ হয়, তখন নিজেদের বাড়িতে কয়েক দিন থেকে মামার বাড়িতে গিয়ে ওঠে। মামার বাড়িতে গেলে মৌসুমি ফল খেতে পারে, প্রায় সব ধরনের ফলই বাড়ির গাছে পাওয়া যায়। ফলগাছগুলো জিতুর নানা অনেক আগেই নিজের হাতে লাগিয়েছিলেন, গাছগুলো খুব বড় বড়, তাই প্রচুর ফল ধরে। যদিও তার নানা মারা গেছেন বছর-ছয়েক আগে, তখন জিতু খুব ছোট ছিল। নানার লাগানো এসব গাছের ফল ভোগ করতে ও বেড়াতে প্রতি বছর এ সময়ে মামার বাড়িতে যায় তারা। বাড়িতে শুধু মামা-মামি আর মামাতো ভাই থাকে। সেই মোতাবেক এবারও জিতুরা মৌসুমি ফল খাওয়ার জন্য মামার বাড়িতে বেড়াতে যাবে কয়েক দিন পরই। মামার বাড়িতে আম, জাম, লিচু, আনারস, জামরুল, কলা, পেয়ারা আরো কত কি! জিতু টাটকা রসালো ফলের লোভ কোনোভাবেই সামলাতে পারে না।

দেখতে দেখতে গ্রীষ্মকালীন ছুটি ঘোষণা হলে তার পরদিনই মা-বাবাসহ মামার বাড়ির উদ্দেশে রওনা হলো। দুপুরের আগেই পৌঁছে যায় মামার বাড়িতে। গাড়ি থেকে নামতে দেখে মিতুল জিতুকে টেনে ঘরের মধ্যে নিয়ে গেল আর বোন ও বোন জামাইকে ড্রয়িং রুমে নিয়ে কুশলাদি করতে লাগল জিতুর মামা-মামি। মামাতো ভাই জিতুর জন্য হরেক রকম খেলনার জিনিস বানিয়ে রেখেছে, সেগুলো একটা একটা করে তাকে দেখাচ্ছে। জিতু দেখে খুব মজা পাচ্ছে, এজন্য মামাতো ভাইকে ধন্যবাদ জানাতেও ভুল করেনি। কথার এক ফাঁকে জিতুর মামি মেহমানদের জন্য নাশতা আনতে ভেতরে চলে গেলেন। জিতুর মা বাড়ির সবার খবরাখবর নিচ্ছেন এবং নিজেদের সম্পর্কেও বলছেন। এর মধ্যে জিতুর মামি সবাইকে নাশতা খেতে ডাকলেন, তখন জিতু হাতের জিনিসগুলো রেখে হাত-মুখ ধুয়ে মা-বাবার সঙ্গে খেতে বসে। খেতে খেতে মামি বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলছেন, আর সবার হাতে বাকি নাশতা আগ বাড়িয়ে দিচ্ছেন। কিছুক্ষণ পর মামি রান্নাঘরে ঢুকে রান্নাবান্নায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। জিতুর মা ভাইয়ের সঙ্গে খোশগল্প করছেন এবং সবার কথা জিজ্ঞেস করছেন। হঠাৎ মা-বাবার কথা স্মরণ করে কাঁদতে লাগলেন জিতুর মা, তখন বোনের সঙ্গে জিতুর মামারও মন খারাপ হয়ে গেল!

এরই মধ্যে দুপুরের রান্নাবান্না প্রায় শেষ করেছেন জিতুর মামি, তিনি গোসল করে ফ্রেশ হয়ে সবাইকে খেতে ডাকলেন। জিতুর মামা জিতুকেসহ বোন ও বোন জামাইকে সঙ্গে নিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসলেন। জিতুর মামি সবার প্লেটের মধ্যে মাছ-মাংসের তরকারি তুলে দিচ্ছেন এক এক করে। সবার মতো জিতুও মজা করে খাচ্ছে, মামি বড় মাছের একটি টুকরো জিতুর প্লেটে দিলে সে বলল আমি এত বড় মাছ কীভাবে খাব! পরে অবশ্য পুরো মাছের টুকরোটি খেতে খুব একটা সমস্যা হয়নি। দুপুরে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে মামাতো ভাইয়ের সঙ্গে একটি খাটে শুতে যায়, শুয়ে শুয়ে নানা রকম গল্প-কথা বলতেই থাকে তারা। গল্প শুনতে শুনতে বিকেল হয়ে গেলে তখন আর শুয়ে থাকতে মন চায় না জিতুর! ঘরের পাশের পাকা ফলের সুবাস নাকে আসতে থাকে। মামাতো ভাইকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ির আশপাশে ঘুরতে বের হয়। জিতু তাকিয়ে দেখল বাড়ির উঠোনে গাছগাছালি কাঁচা-পাকা আমে ভরপুর! তখন পাকা আম খাওয়ার লোভ সামলাতে পারে না জিতু।

জিতু গাছে উঠতে পারে না, তাই মামাতো ভাই মিতুলকে গাছে উঠে আম পাড়তে বলল। মামাতো ভাই মিতুল বলল আচ্ছা ঠিক আছে, আমি গাছে উঠছি তুমি নিচে থেকে আমগুলো কুড়িয়ে ঝুড়িতে রাখবে। মিতুল গাছে উঠে একটা ডাল ঝাড়া দিতেই গাছের অনেকগুলো আম হুড়মড় করে নিচে পড়তে শুরু করল। জিতু আস্তে আস্তে একটা একটা করে আম কুড়িয়ে ঝুড়ির মধ্যে রাখল। এর মধ্যে একটা আম পাকা টসটসে রসালো, জিতু সেটা চামড়া ছিঁড়ে হাতের মধ্যে রেখে চুষে চুষে খেতে থাকল। আমটি যেমন রসালো তেমন মিষ্টি, স্বাদ যেন জিবে লেগে রয়েছে।

এরপর পুকুরের দিকে হাঁটতে গিয়ে জামগাছে কালো কালো জাম দেখতে পেল। এবারও জিতু মিতুকে বলল, এই জাম পাড়বে কীভাবে? মিতুল বলল, আমি একটি বড়সড় বাঁশ নিয়ে আসি, গাছের ডালে ঝাড়া দিলেই পড়বে। জিতু বলল, ঠিক আছে আমি অপেক্ষা করছি তুমি নিয়ে আস। মিতুল বাঁশ নিয়ে এসে যেই না ঝাড়া দিল অমনি টুপটাপ করে জামগুলো পড়তে শুরু করল। মাটি থেকে জামগুলো তুলে নিয়ে একটি খাঁচায় ভরে রাখল জিতু। পরে ঘরের মধ্যে নিয়ে সন্ধ্যাবেলায় লবণ-মরিচ দিয়ে জাম বানিয়ে সবাই মিলে মজা করে খেল। জিতুরা আসছে দেখে পুকুরের পূর্ব পাড়ে লাগানো বিশাল কাঁঠালগাছ থেকে মামা বেশ কটি কাঁঠাল পেড়ে ঘরের ভেতর রাখেন। যেহেতু কাঁঠাল পাকতে কয়েক দিন সময় লাগবে, তাই জিতুকে বলল, এ কদিন অন্য যে ফলগুলো আছে তা খেতে থাকবে। ২-৩ দিন পর কাঁঠাল পাকলে তখন খেতে পারবে, জিতু বলল, আচ্ছা মামা ঠিক আছে। জিতুর বাবা-মাও বাড়ির মিষ্টি মিষ্টি ফলগুলো খেতে থাকল আর ভাই-ভাইয়ের বউয়ের সঙ্গে নানা বিষয় নিয়ে প্রতিদিন গল্প কথায় সময় কাটাতে লাগল।

যেহেতু জিতুর মা-ভাইয়ের একমাত্র বোন তাই মামা, বোনকে খুব সমীহ করেন। যখনই বোন-ভাগিনা বেড়াতে আসেন খুব খুশি হন। তিনি জানেন জিতুরা গ্রীষ্মের অবকাশ পেলে তবেই বেড়াতে আসে, সেজন্য কিছু হাঁস-মুরগি তাদের জন্য রেখে দেন, যাতে তাদের আপ্যায়নে কোনো ধরনের সমস্যা না হয়। হরেক রকমের ফল এই কয়েকদিন খাওয়ার পাশাপাশি পুকুরের তরতাজা মাছ ও পালিত হাঁস-মুরগির রান্না করা মাংস বেশ মজা করে খেতে লাগল জিতুরা। এর মধ্যে পাকা কাঁঠালের গন্ধে পুরো ঘর মণ্ডম করছে, এক দিন দুপুরে ভাত খাওয়ার পর মামি একটি কাঁঠাল ভেঙে প্লেটের মধ্যে কোষ রাখলে সবাই মজা করে খেতে লাগল। কাঁঠাল যেমন রসালো, তেমনি আবার খুব মিষ্টি। খেয়ে সবার তৃপ্তি মিটে গেল, স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে। এ কদিনে এক এক করে সব ফলই খাওয়া হয়ে গেল। সারা বাড়ি জুড়ে নানা ধরনের গাছের ফল, ফলের মিষ্টি ঘ্রাণ নাকে এলেই ভালো লাগায় অন্যরকম অনুভূতি হয় জিতুর।

স্কুলের নির্ধারিত ছুটি শেষের দিকে, এবার ফেরার পালা ফিরতে হবে শহরের বাসায়। ব্যাগের ভেতর কাপড়চোপড় সবকিছু গোছানো শুরু করে জিতুরা। খুব ভালো সময় কেটেছে এই কদিন, ফিরতেই যেন মন চাচ্ছে না জিতুর। যেহেতু ছুটি প্রায়ই শেষ ফিরতেই হবে, দু-একদিন পরই স্কুল খুলবে। মামা-মামির জন্য আবার সঙ্গী মামাতো ভাইয়ের জন্যও মন কাঁদে জিতুর, তার সঙ্গে এই কদিন দুষ্টুমি আর মজায় মজায় ভালোই দিন কেটেছে। ফিরার সময় জিতুর মামা খাওয়ার জন্য বেশ কিছু মৌসুমি ফল একটি ব্যাগের মধ্যে ভরে দিলেন, যাতে তার বাসায় ফিরে খেতে পারে। মামা-মামিকে সালাম করে, মিতুল থেকে বিদায় নিয়ে মা-বাবার সঙ্গে শহরের পথে যাত্রা শুরু করল জিতু। শহরে যেতে যেতে গাড়ির মধ্যে মামার বাড়ির সুখ স্মৃতিটুকু বারবার চোখে ভেসে ওঠে, আবার কবে আসা হবে সে সময়ের অপেক্ষায় থাকে জিতু!

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close