ইমতিয়াজ সুলতান ইমরান

  ০১ এপ্রিল, ২০২৩

ধারাবাহিক কিশোরগল্প

ছুঁ মন্তর ছুঁ

চার.

কিছুদিন ধরে মিজানের গুরু বিশেষ ধ্যানে মগ্ন। মিজান কোথায় আছে? কোন বাজারে যাচ্ছে? আজ কোথায় যাবে? সবকিছুই ধ্যানে দেখেন এবং জানেন। আজ তিনি ক্রেতার ছদ্মবেশে মিজানের ঘোড়া কিনতে যাবেন। যাবেন কী? আগে থেকেই বাজারে গিয়ে ঘোরাঘুরি করছেন। মিজান ঘোড়া নিয়ে বাজারে এসেছে। বিক্রেতার সারিতে দাঁড়িয়েছে। মিজানের ওস্তাদ আগে থেকেই বিশেষ মন্ত্র পড়ে ঘোড়ার বাজারে ধূলিপড়া ছিটিয়ে রেখেছেন। মিজান যাতে ওস্তাদকে চিনতে না পারে। সে যেন ঘোড়ার লাগাম আর চাবুকের প্রতি মনোযোগী না থাকে সেই মন্ত্র জপ করছেন। তিনি মনে মনে প্রার্থনা করছেন,

‘প্রভু তোমার নাম জপিয়া

শক্তি পেল ফেরাউন

তুমি তাকে দিয়েছিলে

কেরামতির শত গুণ।

আমি হলাম ফেরাউনের

চামচা ও ভাইবেরাদর

ফেরাউনের মতো আমায়

করো তুমি ফের আদর।

এই জগতে আমায় দিলে

গুরু নামের পরিচয়

পরকালের পাপী আমি

নয়কে আমি করি ছয়।

গুরুর মান রক্ষা করো

ভুবন যেন করি জয়।’

মিজানও গুরুর শেখানো মন্ত্র জপ করছে...। গুরু ক্রেতার বেশে মিজানের কাছে গিয়েও মনে মনে মন্ত্র পাঠ করছেন। আবার একটু দূরেও সরে গেছেন। দূরে গিয়ে ঘুরেফিরে আবার মিজানের কাছে এসেছেন। ঘোড়ার দাম জিজ্ঞেস করছেন। দাম জেনে নিয়েছেন। সাধারণ ক্রেতার বেশে খুব দর-কষাকষি করছেন। দর-কষাকষির ফাঁকে ফাঁকে মনে মনে মন্ত্র জপ করছেন। একপর্যায়ে দর-দামে হয়ে গেল। ক্রেতার বেশে ঘোড়াটিকে একটু দৌড়িয়ে দেখতে চাইলেন। মিজান লাগাম আর চাবুকের কথা ভুলে গিয়ে সহজে ক্রেতার হাতে দিয়ে বলল, দেখুন। একবার কেন? একশোবার দৌড়িয়ে দেখুন। এটা যেমন- তেমন ঘোড়া নয়! এক্কেবারে পঙ্খিরাজ ঘোড়া। চাবুক দেওয়ার আগেই হাওয়ায় উড়াল দেবে। ক্রেতা লাগাম আর চাবুক হাতে নিয়েও ঘোড়ার পিঠে চড়ছেন না। না চড়ার ভান করছেন। বলছেন, আপনার ঘোড়া দৌড়াতে হবে না। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, এটা খুব দুরন্ত হবে। ‘দুরন্ত’ শব্দটি উচ্চারণ করার সঙ্গে-সঙ্গে মিজানের মনে পড়ে গেল, ওর ওস্তাদের ঘোড়ার নাম ‘দুরন্ত’। তা ছাড়া তার ওস্তাদ এই ঘোড়াকে ওই ডাকতেন। এই নামটি সাধারণ কোনো ক্রেতার জানার কথা নয়। মিজান একটু ধ্যানমগ্ন হতেই বুঝতে পারে এই ছদ্মবেশী ক্রেতা তার ওস্তাদ। ওস্তাদও মুহূর্তেই বুঝে গেলেন মিজান ওনাকে চেনে ফেলেছে। উনি একলাফে ঘোড়ার পিঠে চড়ে চাবুক মারলেন। চাবুক মারার সঙ্গে-সঙ্গে ঘোড়াটি ঝড়ের বেগে দৌড়াতে থাকে। মিজান চিৎকার করে বলতে থাকে, আমাকে সাহায্য করুন। আমাকে টাকা না দিয়ে ঘোড়া নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। মিজান আরেকটি ঘোড়া নিয়ে তার ওস্তাদের পিছু ছুটল। মনে-মনে ওস্তাদকে আয়ত্ত করার মন্ত্র জপ করতে থাকল এবং আল্লাহকে স্মরণ করে তার সাধন করা দোয়া করছে,

‘ছুঁ মন্তর ছুঁ...

আল্লার নাম জপ করিয়া ফুঁ...

আল্লা তুমি দাও তাড়িয়ে এই জগতের কু।’

মিজানের সঙ্গে বাজারের সব ঘোড়া বিক্রেতা নিজেদের ঘোড়া নিয়ে ঘোড়া চোরকে ধাওয়া করল। সাধক দেখলেন, এত লোকের চোখকে ফাঁকি দেওয়া সম্ভব নয়। তা ছাড়া মিজানের মন্ত্রও ওনার গতি রোধ করছে। তিনি ভাবলেন, ঘোড়াকে ছেড়ে দিলে ঘোড়াও যাবে। তিনিও সবার কাছে ধরা পড়ে বাজারি মার খাবেন। তিনি সঙ্গে-সঙ্গে মন্ত্র পড়ে ঘোড়ার সঙ্গে মিশে গেলেন। মিশে গিয়ে একটা পুকুরে ঝাঁপ দিলেন। পুকুরে ঝাঁপ দিয়েই শোল মাছের রূপ ধারণ করলেন। শোল মাছের মাঝে এখন মিজানের ওস্তাদ এবং তার দুরন্ত ঘোড়া।

সবাই দেখল, ঘোড়াটি পুকুরে ঝাঁপ দিল। কিন্তু পুকুরে কোনো ঘোড়া নেই! মানুষও নেই! সবাই খুব অবাক হয়ে পুকুর পাড়ে ভিড় জমাল। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করল। কিন্তু পুকুরের পানিতে কোনো নড়াচড়া নেই! মিজান ধ্যানমগ্ন হয়ে দেখতে পেল, তার ওস্তাদ শোল মাছের রূপ ধরে পানির নিচে একটি গর্তে চুপ করে বসে আছেন। কিন্তু সে এই কথা কারো কাছে প্রকাশ করল না। কাউকে কিছু বুঝতে দিল না। যে যার ঘোড়া নিয়ে ছুটে এসেছিল তার ঘোড়া তাকে বুঝিয়ে দিল। ওস্তাদকে ধরার সুযোগ খুঁজতে শুরু করল। সবাই ধীরে-ধীরে চলে গেল। মিজান পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে রইল। পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে বুদ্ধি করল, তাকে অজগর সাপ হতে হবে। অজগরের রূপ ধরলে শোল মাছটি ধরতে পারবে। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। মিজান মন্ত্রপাঠ করে অজগর সাপ হয়ে গেল। অজগরের রূপ ধরে মিজান পুকুরে নেমে গেল। পুকুরে নেমে এক-এক করে মাছ গিলতে শুরু করেছে। ওস্তাদ অজগরের আক্রমণ থেকে বাঁচার উপায় খুঁজছেন। অজগর প্রচুর মাছ গিলছে। অনবরত মাছ গিলে পুকুর খালি করতে যাচ্ছে। যত সময় যাচ্ছে ওস্তাদের বিপদ তত বাড়ছে। পুকুর খালি হয়ে গেলে অজগর ওস্তাদকে পেয়ে যাবে। পানির নিচে চলছে গুরুশিষ্যের মন্ত্রের বাহাদুরি। শিষ্য খুঁজছে গুরুকে। আর গুরু ফাঁকি দিচ্ছেন শিষ্যের চোখকে। কিন্তু ওস্তাদকে তো শিষ্যের হাত থেকে বাঁচতেই হবে। মহাসাধক বলে কথা। এত সহজেই কি শিষ্যের কাছে গুরু হার মানে? গুরু ভাবছেন এবার পুকুর থেকে যেকোনো রূপেই হোক ডাঙায় উঠতে হবে। কিন্তু সেটা কীভাবে? তিনি দেখেছেন, যে বাড়ির পুকুর, সেই বাড়ির গিন্নি পুকুর থেকে কলস দিয়ে পানি তোলেন। ওস্তাদ ভাবলেন, কলসে ঢুকেই একমাত্র ডাঙায় ওঠা সম্ভব। ওস্তাদ মনে-মনে ঠিক করলেন, তিনি দারকিনা মাছের রূপ ধরে পানির ওপরে ভেসে বেড়াবেন। অজগর এখন পুকুরের তলদেশে। সে মাটি কামড়িয়ে শোল মাছকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। এই সুযোগে শোল মাছ দারকিনার রূপ ধরে পানির ওপরে ভেসে আছে। অপেক্ষা করছে, বাড়ির গিন্নি কখন কলস দিয়ে পানি তুলতে আসেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close