আহমাদ কাউসার

  ২৫ মার্চ, ২০২৩

দাদুর যুদ্ধ বিজয়

বিজয় দিবসের ছুটি পেয়ে আবিরের বাবা আবিরকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে আসে। দাদু-দাদিকে কাছে পেয়ে খুশির অন্ত নেই আবিরের। সকালেই তারা বাড়িতে এসেছে। দাদুর সঙ্গে সমস্ত গ্রাম ঘুরে দেখছে আর মজার মজার গল্প শুনছে। আবিরের বায়না হচ্ছে- রাতে দাদুর সঙ্গে শোবে আর মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনবে, আবিরের দাদু মুক্তিযুদ্ধ করেনি তবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেছে। গ্রাম ঘুরে সন্ধ্যার আগে দাদু-নাতি ঘরে ফিরল। আবিরের বাবা-মা দাদু-দাদি সবাই একসঙ্গে বসে পারিবারিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনার শেষে রাতের খাবার খেল। খাবার শেষে এবার শোতে যাওয়ার পালা। আবির আগেই মাকে বলে রেখেছে দাদুর সঙ্গে শোবে এবং গল্প শুনবে। গ্রামের লোকজন রাতে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ে। আবিরের দাদু আবিরকে নিয়ে তার শোবার ঘরে চলে গেল।

ডিসেম্বর মাস প্রচণ্ড শীত। লেপ মুড়িয়ে দুজন শোয়ে পড়ল। আবির দাদুকে বলল, দাদু! এবার গল্প শুরু করো। দাদু বলল, শুনো তাহলে- মুক্তিযুদ্ধের গল্প। আবির মুক্তিযুদ্ধের গল্পের কথা শুনে খুশিতে দাদুকে বলল, ‘হ্যাঁ দাদু বলো। ‘মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে আমাদের গ্রামে কোনো মিলিটারি আসেনি। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল মার্চে, আমাদের গাঁয়ে মিলিটারি এলো এপ্রিলের শেষের দিকে। মিলিটারিরা এসেই জ্বালাও-পোড়াও শুরু করল। রাজাকাররা এদের নিয়ে বাড়ি বাড়ি যেতে লাগল। যাকে সামনে পাচ্ছে ধরে নিয়ে যাচ্ছে ক্যাম্পে। আমি তখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। আমাদের বাড়ির সামনে যে খালটা দেখছিস এখানে তখন হাঁটুপানি ছিল। খাল পেরিয়ে আমাদের পাড়ায় ঢুুকতে হতো। অন্য কোনো রাস্তা ছিল না। গাঁয়ের রাজাকার মিলিটারি নিয়ে আমাদের পাড়ায় ঢোকার জন্য খালের পানিতে নামল। খালের মাঝ বরাবর আসতেই এক মিলিটারি চিৎকার দিয়ে উঠল। তার পায়ে শিং মাছের কাটা বিঁধেছে। সেই কি চিৎকার! তার চিৎকার শুনে বাকি মিলিটারিরা ভয় পেয়ে গেল। সেদিন আর ওরা আমাদের পাড়ায় ঢুকল না। রাজাকাররা তাদের নিয়ে ক্যাম্পে ফিরে গেল। আমাদের পাড়ার লোকজনের মধ্যে ভয় ঢুকে গেল। তারা যেকোনো সময় এসে বাড়িঘর পুড়িয়ে দেবে। বাড়িঘর ছেড়েও কেউ যেতে চাচ্ছে না। সবার ঘরে গোয়ালভরা গরু, গোলাভরা ধান। এগুলো ফেলে কেউ কোথাও যেতে রাজি নয়।

চারদিকে আতঙ্ক, আর ভয়। গাঁয়ের অনেক লোক বাড়ি ছেড়ে ইন্ডিয়া চলে গেছে। ওইদিন শিং মাছের গুঁতো খেয়ে মিলিটারিরা চলে যাওয়ার পর পাড়ার সবাই সিদ্ধান্ত নিল কেউ কোথাও যাবে না। মিলিটারি এলে জঙ্গলে ঝোপঝাড়ে লুকিয়ে থাকবে। আমি পাশের বাড়ির মতি ও পাড়ার আরো আট-দশজন ছেলে খেয়াল রাখতাম মিলিটারি আসছে কি না। খালের পুব পাশে যে রাস্তাটা দেখছিস এটাই ছিল আমাদের পাড়ায় ঢোকার একমাত্র রাস্তা। তখন রাস্তাটা অনেক সরু ছিল। দুপাশে জঙ্গল আর ঝোপঝাড় ছিল। মতি খুব দুষ্টু আর ডানপিটে ছিল। মাথায় বুদ্ধিও ছিল খুব। সে আমাকে বলল কাশেম, ‘মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে।’ আমি বললাম কী? ‘যখন দেখব মিলিটারি আমাদের পাড়ার দিকে আসছে, তখন রাস্তার পাশে বড় আমগাছটায় থাকা দুটো মৌচাকে আমরা ঢিল মেরে লুকিয়ে থাকব। মৌমাছিরা আমাদের না পেয়ে মিলিটারিদের কামড়াবে, কামড়ের ব্যথায় তারা পিছু হটবে। মতির কথামতো আমরা প্রতিদিন রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। এভাবে দণ্ডইতিন দিন কেটে গেল। চতুর্থ দিন দুপুরে হঠাৎ দেখতে পেলাম মিলিটারিরার আমাদের পাড়ার দিকে আসছে। আমরা সুবিধামতো ঝোপে লুকিয়ে আছি। আগে থেকেই ইটের টুকরো সংগ্রহ করে রেখেছিলাম। যেই মাত্র আমগাছটির কাছাকাছি ওরা পৌঁছাল, মারলাম মৌচাকে ঢিল। মুহূর্তের মধ্যেই ওদের ধাওয়া করল মৌমাছিগুলো। সারা গায়ে শূল বিদ্ধ করতে লাগল। উপায় না দেখে তারা দৌড়ে পিছু হটল।’ তোমাদের গুলি করেনি ওরা? আমাদের ওরা দেখেনি! আমরা গাছটির কাছে পৌঁছানোর আগেই মৌচাকে ঢিল ছুড়ে মৌমাছিগুলোকে উত্তেজিত করেছি, যাতে গাছটির বরাবর ওরা পৌঁছালেই কামড় শুরু করে।

তারপর ওরা আর আসেনি? না! আমাদের পাড়ায় মিলিটারি আর আসেনি। গ্রামের অন্য এলাকার লোকজন আমাদের পাড়াকে নিরাপদ মনে করে আশ্রয় নিল। আমরা সবাই মিলে তাদের আশ্রয় দিলাম। যুদ্ধের বাকি দিনগুলো আমরা নিরাপদে ছিলাম।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close