ইমদাদুল হক শেখ

  ১৮ মার্চ, ২০২৩

রাজা বাবু

তখন আমি শিক্ষার্থী। পড়াশোনার সুবাদে বছরের অধিকাংশ সময় বাড়ির বাইরে থাকতে হতো। শুধু রোজার মাসটা বাড়িতে কাটাতাম। কারণ আব্বা আমার পিছে তারাবির নামাজ পড়তে খুবই তৃপ্তিবোধ করে। বাড়িতে এলে মসজিদের ইমাম সাহেব হুজুরও বেশ খুশি হন। খানিকটা স্বস্তির শ্বাস নিতে পারেন। মাঝে মাঝে তার পরিবর্তে মক্তবের দায়িত্ব আমিই পালন করে দিই।

এক দিন দুপুরে বাচ্চাদের পড়াচ্ছি, এমন সময় কে যেন পেছন থেকে আমার গলা জোরে ঝাপটে ধরল। আমি বললাম কে? কে তুমি? গলা ছাড়ো। গলা ছেড়ে সামনে এসে বলছে আমার নাম রাজা। সবাই আদর করে রাজা বাবু বলে ডাকে।

তাই নাকি! হ্যাঁ। রাজা আমাদের গ্রামের কাওসার চাচার নাতির ছেলে। বয়স পাঁচ পেরিয়ে ছয় ছুঁই ছুঁই। শুধুই শিক্ষাঙ্গনে পদচারণা শুরু হয়েছে। মায়াময় চেহারা। কথাগুলো রসগোল্লার মতো মিষ্টি, কথা বললে শুধু শুনতেই মন চায়। বেশি চকলেট খাওয়ার কারণে সামনের দাঁতগুলো পোকা খেয়ে তরমুজের বিচির মতো কালো হয়ে গেছে। ফোকলা দাঁত তার সৌন্দর্য আরো দিগুণ করে দিছে। তার চাঞ্চল্যতা ও দুরন্তপনা আমাকে খুব আনন্দিত করত।

আমি বললাম, আচ্ছা রাজা বাবু, তুমি কি জানো মক্তবে এসেই আগে উস্তাদকে সালাম দিতে হয়? সে ঘাড় নাড়িয়ে না জানাল। ঠিক আছে, তাহলে বলো আসসালামু আলাইকুম। এভাবে তাকে প্রথম দিন সালাম ও তার উত্তরে ওয়ালাইকুম আসসালাম বলতে হয়- শিখিয়ে দিলাম এবং এটাও শিখিয়ে দিলাম যে, রাস্তাঘাটে, বাড়িতে-গাড়িতে সব জায়গায় বড়- ছোট সবাইকে সালাম দিতে হবে।

যথানিয়মে সে প্রতিদিন দুপুরে পড়তে আসত। আমিও তাকে নতুন নতুন বিষয় শেখাতাম। এতে আমার প্রতি তার কচিমন এতটাই ঝুঁকে পড়েছিল যে, মাঝে মাঝে আমার বাড়িতেও চলে আসত আমাকে দেখার জন্য। সে নাকি আমাকে ছাড়া বেশি সময় থাকতে পারে না। তার মায়াময় চেহারা ও মিষ্টি মিষ্টি কথা আমাকেও বেশ দুর্বল করে ফেলেছিল।

এক দিন দুপুরের ঘটনা। সব বাচ্চা মক্তবে উপস্থিত হয়েছে কিন্তু রাজার স্থানটা খালি। সে কেন যে আসেনি তাও বুঝে উঠতে পারছি না। ওর জন্য বারবার মনটা অস্থির হয়ে উঠছে। ওকে ছাড়া আমার পড়ানো একদমই জমছে না। থেকে থেকে মনের কোণে বিভিন্ন চিন্তা দাগ কাটছে। আজ সবাইকে তড়িঘড়ি করে পড়িয়ে ছুটি দিয়ে দিলাম। মনে মনে ভাবলাম রাজাকে গিয়ে দেখে আসি। রাজাদের বাড়িতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে যেই মক্তব থেকে বের হব, তখনই রাজার বাবা পাগলের মতো ছুটে এসে বলল হুজুর আপনার রাজা আর নেই, কথাটা বলতেই তার বাবা হাও-মাও করে কেঁদে ফেলল। এ কথা শোনার ব্যাপারে আমার কান ছিল সম্পূর্ণভাবে অপ্রস্তুত। কথাটা শোনা মাত্রই মনে হলো আসমান ভেঙে মাথায় পড়েছে। চোখের কোনা ভিজে উঠেছে। এক-দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে জামায় পড়ল।

তার পরও নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে রাজাকে দেখতে গেলাম। ছোট একটা খাটে রাজার নিথর দেহটা পড়ে আছে, পানিতে ডুবে যাওয়ার কারণে শরীর কিছুটা ফুলেও গেছে। চোখ দুটি খোলা ছিল। কেন যেন তার চোখের ভাষা আমাকে ডেকে বলছে হুজুর, ‘আজ থেকে আর কেউ পেছন থেকে আপনার ঘাড়ে চেপে বসবে না। বিরক্ত করবে না। আমি আল্লাহর কাছে চলে এসেছি। আপনি ভালো থাকবেন।’ আমি ধৈর্য ধারণ করতে না পেরে হু-হু করে কেঁদে ফেললাম এবং বিড়বিড় করে বলতে লাগলাম ‘রাজা বাবু’ তুমিও ভালো থেকো। তার মা-বাবাকে ধৈর্য ধারণ করতে বলে আমিও চলে এলাম।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close