ইমতিয়াজ সুলতান ইমরান

  ১৮ মার্চ, ২০২৩

ধারাবাহিক কিশোরগল্প

ছুঁ মন্তর ছুঁ

তিন.

আজ ওস্তাদ মিজানকে ডেকে বললেন, তুমি দুরন্তকে নিয়ে বাজারে যাবে। ওস্তাদের ঘোড়ার নাম দুরন্ত। ঘোড়াটি নামে যেমন দুরন্ত, কাজেও দুরন্ত। ওস্তাদ মিজানকে বুঝিয়ে বললেন, আজ তোমার সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা। এই দুরন্ত ঘোড়ার লাগাম আর চাবুক একবার যদি কারো হাতে যায়, তাহলে ঘোড়া তার অনুগত হয়ে যাবে। ঘোড়া তাকে পিঠে তুলে নেবে। আর চাবুক মারার আগেই উল্কা গতিতে ছুটে যাবে। মিজান মনে-মনে ভাবল, আজ যদি সে ঘোড়া বিক্রি করে ঘোড়ার লাগাম আর চাবুক হাতে রাখতে পারে তাহলে সে তার নিজের বাড়িতে চলে যাবে। ওস্তাদের কাছে আর আসবে না। এই ঘোড়া নিয়ে সে যেদিকে ইচ্ছে সেদিকে ছুটতে পারবে। প্রয়োজনে ঘোড়ায় চড়ে দূর-দূরান্তে পালিয়ে যাবে এবং ওস্তাদকে ভাগে পাওয়ার জন্য ঘোড়াটি নিয়ে দূরের বাজারে যাবে। নিশ্চয় ওস্তাদ তার ঘোড়াকে ধরার জন্য বাজারে-বাজারে ঘুরবেন। তখন ওস্তাদকে ভাগে পাওয়া যাবে। আজও ওস্তাদ মিজানকে একটি দোয়া শিখিয়ে দিলেন। দোয়াটি হলো,

‘ঘোড়া তুমি দৈত্য দানোর জাত

দৈত্য দানো খুব করে উৎপাত।

মানুষের চে’ নয়কো তারা বড়

ঘোড়া তুমি মানব-পূজা কর।

মানুষের চে’ দৈত্য বড় নয়

আমার গুরু এমন কথা কয়।

গুরুর প্রতি আমার আছে ভক্তি

গুরুর কৃপায় প্রভু দিয়ো শক্তি।’

: বাহ্! এই ছড়াটিও খুব সুন্দর। সাধে কি ছড়া লিখতেন দাদু?

: জানি না। আমি তো এই গল্পটি একটি বইয়ে পড়েছি। তবে সাধকের দোয়া পড়ে আমারও মনে হয়েছিল, ওনার ভালো ছন্দজ্ঞান ছিল। উনি ছন্দে-ছন্দে প্রার্থনা লিখতেন।

: ঘোড়া কি সত্যি দৈত্য দানোর জাত দাদু?

: তাও জানি না। তবে লোকে বলে ঘোড়া দৈত্য দানোর জাত। ঘোড়া দ্রুতবেগে দৌড়াতে পারে। সহজে ক্লান্ত হয় না। ঘোড়া দাঁড়িয়ে ঘুমায়। তাই হয়তো লোকে এমন কথা বলে।

মিজান গুরুর শেখানো প্রার্থনা জপ করে, ঘোড়া নিয়ে বাজারে গেল। অনেকেই ঘোড়া কিনতে গিয়ে লাগাম আর চাবুক হাতে নিয়ে ঘোড়াকে দৌড়িয়ে দেখতে চাইল। কিন্তু মিজান ঘোরার লাগাম আর চাবুক কারো হাতে দিতে চাইল না। দৌড়িয়ে না দেখে ঘোড়া অনেকেই কিনতে চাইল না। তাই সহজে ঘোড়াটি বিক্রি করতে পারছে না। এভাবে রাত হয়ে গেল। মিজান গুরুর শেখানো প্রার্থনা জপ করছে...। শেষে একলোক জিজ্ঞেস করল, ঘোরা বিক্রি করলে লাগাম আর চাবুক দেবে না কেন? মিজান বলল, এটা আমার ওস্তাদের ঘোড়া। তিনি আমাকে নিষেধ করেছেন, যিনি কিনবেন তাকে ঘোড়ার লাগাম আর চাবুক না দিতে। লোকটি লাগাম আর চাবুক ছাড়াই ঘোড়াটি কিনে নিল। মিজান সুযোগ পেয়ে ঘোড়ার লাগাম আর চাবুক নিয়ে নিজের বাড়িতে চলে গেল। এদিকে তার ওস্তাদ মিজানের দেরি দেখে ধ্যানে বসলেন। ধ্যানে বসে দেখতে পেলেন, মিজান ঘোড়া বিক্রি করে টাকা, লাগাম আর চাবুক নিয়ে তার নিজ বাড়িতে চলে গেছে। তিনি মনে-মনে ঠিক করলেন, ওই নিমকহারাম মিজানকে উচিত শিক্ষা দেবেন। ওকে কঠিন শাস্তি দেবেন। মিজান বাড়িতে গিয়ে মাকে বলল, আজ বাজার থেকে ফিরতে অনেক দেরি হয়ে গেল মা। তাই ভাবলাম, আজ রাতটা তোমার কাছে থাকব। কাল সকালে ওস্তাদের বাড়িতে যাব। মা ছেলেকে কাছে পেয়ে খুব খুশি হলেন। ছেলেকে নিজের হাতে রান্না করে ভালো কিছু খাওয়ানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। মিজান বিশ্রাম নিচ্ছে আর ভাবছে, ওস্তাদের কবল থেকে কীভাবে বাঁচা যায়? সে ধ্যান ধরে দেখল, ওস্তাদ প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তার বাড়িতে ছুটে আসছেন। মিজান ভাবল, মায়ের রান্না শেষ হলেই খাওয়া-দাওয়া করে বাড়ি থেকে ঘোড়ার লাগাম আর চাবুক নিয়ে পালিয়ে যাবে। সে লাগাম আর চাবুক নিয়ে যেখানে থাকবে ঘোড়া সেখানেই যাবে।

খাওয়া-দাওয়া শেষ। হঠাৎ শুনে বাড়ির উঠোনে ঘোরার পায়ের শব্দ। মিজান দরজা খুলে বের হয়। দেখে তার বিক্রি করা ঘোড়াটি রাতেই চলে এসেছে। মিজান তার মাকে বলল, মা দেখেছো? ওস্তাদের বাড়ি থেকে ঘোড়া এসেছে আমাকে নেওয়ার জন্য। ঘোড়া যখন এসেই গেছে আমি তাহলে চলে যাই মা। তুমি আমার জন্য দোয়া করো। মিজান ঘোড়ায় চড়ে বিদ্যুৎ গতিতে ছুটে গেল। দূর থেকে দূরে। অনেক দূরে। ওস্তাদ আবার ধ্যানে বসে দেখলেন, মিজান অনেক দূরে চলে গেছে। তিনি মিজানের ওপর খুব রেগে গেলেন। রাগে মিজানের মায়ের কাছে এলেন। মাকে বললেন, মিজান কোথায়? মা বললেন, হুজুর মিজান তো চলে গেছে। আপনি মিজানের দেরি দেখে যে ঘোড়া পাঠালেন, মিজান সেই ঘোড়ায় চড়ে চলে গেছে। আপনার সঙ্গে দেখা হয়নি বুঝি? সাধক বুঝতে পারলেন, মা ওইসব কিছুই জানেন না। তিনি মনে-মনে ভাবলেন, মিজানের মাকে বন্দি করলে। তার মাকে শাস্তি দিলে সে সহ্য করতে পারবে না। মায়ের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে ঘোড়া নিয়ে ছুটে আসবে। তিনি মিজানের মাকে মন্ত্র-পাঠে ঘোড়া বানিয়ে নিলেন। ঘোড়া বানিয়ে ওই ঘোড়ার পিঠে চড়ে বাড়িতে গেলেন। বাড়িতে যাওয়ার পথে ঘোড়ার পিঠে চাবুক মেরে বলছিলেন, তোর অনুরোধে আমি তোর ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়েছি। অনেক বড় করেছি। আজ তোর ছেলে আমার দুরন্ত ঘোড়া নিয়ে পালিয়েছে। তোর ছেলে আমার ঘোড়া নিয়ে না আসা পর্যন্ত আমি তোকে ঘোড়া বানিয়ে রাখব। আমি তোর পিঠে চড়ব। তোকে চাবুক মারব। দেখি তোর ছেলের কত মায়া তোর প্রতি।

মিজানের মাকে ঘোড়া বানিয়ে সাধক সিদ্ধান্ত নিলেন, মিজানের পিছু ছুটে এভাবে সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না। সে কিছুদিন পালিয়ে বেড়াক। ওকে কৌশলে ধরতে হবে। ছদ্মবেশে ধরতে হবে। সে যখন জানবে আমি তার মাকে শাস্তি দিয়ে ঘোড়া বানিয়ে রেখেছি তখন সে নিজে এসেই আমার কাছে ধরা দেবে।

রাত পোহালো। সকাল হলো। মিজান ঘোরার লাগাম আর চাবুক হাতে নিয়ে ঘোড়াটিকে মাঠে ছেড়ে দিল। ভাবল, ঘোড়াটি কিছু খাওয়া-দাওয়া করে নিক। তারপর ঘোড়া নিয়ে পাশের বাজারে উঠবে। বিক্রি করবে না। বিক্রি না করে ঘোড়া নিয়ে কোনো নিরাপদ স্থানে রাত কাটাবে। বিপদে পড়লে ঘোড়ার পিঠে চড়ে উল্কাবেগে দূরে চলে যাবে। মিজান একটা গাছতলায় বিশ্রাম নেওয়ার চেষ্টা করল। একটু ঘুমোতে চাইল। মিজান বিশ্রামে গিয়ে ধ্যানমগ্ন হলো। ধ্যানে দেখতে পেল, তার ওস্তাদ বাড়িতেই আছেন। আরো দেখতে পেল, তার মাকে ঘোড়া বানিয়ে শাস্তি দিচ্ছেন। মিজান তার মায়ের এই কষ্ট দেখে আরো প্রতিবাদী হয়ে উঠল। মিজান মনে-মনে আরো দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করল, সে নিজে ধরা দেবে না। নিজে ধরা দিলে, তাকে এবং তার মাকে সাধক ছাড়বেন না। দুজনকে আরো কঠিন শাস্তি দেবেন। কারণ, আমরা ওনার অপকর্ম জেনে গেছি। মিজান ঘোড়াকে লাগাম পরিয়ে বাজারে নিয়ে গেল। এভাবে প্রতিদিন ঘোড়া বিক্রি করতে যায়। আজ এই বাজারে। কাল ওই বাজারে। অনেকেই ঘোড়াটি কিনতে চান। ঘোড়াটি সুন্দর দেখে লাগাম আর চাবুক ছাড়াই কিনতে চান। কিন্তু মিজান কারো কাছে ঘোড়া বিক্রি করে না। অতিরিক্ত দাম চেয়ে ঘোড়াটি বিক্রি না করার চেষ্টা করে। মিজানের উদ্দেশ্য, তার ওস্তাদ যেন ঘোড়া কিনতে আসেন। তিনি এলে যেকোনো মূল্যে ঘোড়াটি কিনতে চাইবেন। এদিকে ওস্তাদ তার ধ্যানে সবই দেখেন। তিনি বুঝতে পারছেন মিজান নিজে এসে ধরা দেবে না। মিজানের কাছ থেকে ঘোড়া আদায় করা এবং মিজানকে আটক করার নীরব ফন্দি আঁকেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close