ইমতিয়াজ সুলতান ইমরান

  ১১ মার্চ, ২০২৩

ধারাবাহিক কিশোরগল্প

ছুঁ মন্তর ছুঁ

দুই.

কয়েক বছর পর। মিজান এখন আর সেই বাচ্চা ছেলে নয়। বেশ বেড়ে উঠেছে। সাধকের বাড়িতে থেকে, বাড়ির মক্তবে পড়াশোনা করেছে। সাধক নিজেও তাকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। সাধকের সঙ্গে থেকে ওনার ফুটফরমাশ শুনে বড় হয়েছে। বাড়ির সব কাজ একা করতে পারে। সাধকের পোষা অনেক পশুপাখি আছে। মিজান এগুলোর সেবা করে। তার ওস্তাদের অনেক গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষ, ঘোড়া আছে। এগুলোকে সামাল দেয়। দুরন্ত একটি ঘোড়া আছে। ঘোড়াটি তার ওস্তাদের খুব প্রিয়। এটার নাম দুরন্ত ঘোড়া। এই দুরন্ত ঘোড়াকে একা সামাল দেয় মিজান। একা একা বাজারে যেতে পারে। এটা-সেটা কেনাবেচা করতে পারে। ওস্তাদের সহকারী হিসেবে কাজ করে। ওস্তাদের অনুপস্থিতিতে অনেক কাজ চালিয়ে নিতে পারে। ঝাড়ফুঁক, তাবিজ-কবজ, জিন-ভূত তাড়ানো, এসব ভালোভাবে কর?তে পারে। ওস্তাদের কাছ থেকে অনেক মন্ত্র শেখেছে। ওস্তাদ মিজানকে অনেক মন্ত্র শিখিয়েছেন।

এবার মিজানকে দিয়ে ওস্তাদের রোজগারের পালা। ওস্তাদ মিজানকে তন্ত্রমন্ত্র শেখালেও ওস্তাদের ওস্তাদি মন্ত্র এখনো শেখাননি। তিনি জানেন, সবকিছু শেখা হয়ে গেলে মিজান ওস্তাদের ওপর ওস্তাদি করতে পারে। মিজানকে বশে রাখার উদ্দেশ্যে তিনি বিশেষ কিছু মন্ত্র গোপন রেখে গেছেন। যেগুলো উনি ছাড়া আর কেউ জানে না।

ওস্তাদ মিজানকে দিয়ে প্রথম রোজগারের একটা ফন্দি করলেন। তিনি মিজানকে ডেকে, কাছে এনে বললেন, আজ তুমি বাজারে গিয়ে একটা ছাগল বিক্রি করবে। ছাগলটি যার কাছেই বিক্রি করো। মানে, যিনি ছাগলটি কিনবেন তাকে শুধু ছাগল দেবে। ছাগলের রশি দেবে না। কেউ ছলে-বলে তোমার কাছ থেকে রশিটি চাইতে পারে। তুমি কোনোভাবেই ছাগলের রশি দেবে না। এই রশিটা যদি তুমি আমার কাছে এনে দাও তাহলে পরেরদিন ছাগলটি আবার আমাদের কাছে ফিরে আসবে। এই একটি ছাগলকে আমরা বারবার বাজারে বিক্রি করতে পারব। এভাবে যে টাকা রোজগার হবে তা থেকে তোমাকে একটা ভাগ দেওয়া হবে। তুমি তোমার মাকে দিতে পারবে। তোমার মায়ের আর কোনো কষ্ট থাকবে না। ওস্তাদের কথা শুনে মিজান খুব অবাক হলো। বলল, হুজুর আপনি না বলেছিলেন, কাউকে ওজনে কম দেওয়া ভালো কাজ নয়? আমাকে এমন কাজ করতে বলছেন কেন? ওস্তাদ মিজানকে ধমক দিয়ে বললেন, ওস্তাদের ওপর ওস্তাদি করতে যেও না। তোমার আরো অনেক কিছু শেখার বাকি আছে। এই কাজগুলো হচ্ছে মাঠের কাজ। মানে প্রেকটিক্যাল কাজ। হাটে-মাঠেও তোমাকে কিছু কাজ করে দেখাতে হবে। তাহলেই বুঝব, তুমি সব কাজ শিখতে পেরেছো। যাও, যা বলছি তা করো। এটা তোমার প্রথম পরীক্ষা। আজকের পরীক্ষায় যদি পাস করো তাহলে ধরে নেব তুমি কিছু শিখতে পেরেছো। এরপর আরো কঠিন-কঠিন পরীক্ষায় তোমাকে পাস করতে হবে। মনে রেখো, ছাগলের রশি যার হাতে যাবে। ছাগল কিন্তু তার হয়ে যাবে। তার কথা বলবে। তার কথা শুনবে। রশি ছাড়া ছাগল যে কিনবে, তার ছাগল যদি পরেরদিন হারিয়ে যায় সে আর ওই ছাগলকে চিনতে পারবে না। তাই রশি ছাড়া ছাগল বিক্রি করলে আমাদের কোনো ভয় নেই।

মিজান নরম স্বরে বলল, জি হুজুর। আমার কাছ থেকে কেউ রশিসহ ছাগল কিনতে পারবে না। কারো হাতে আমি ছাগলের রশি দেব না।

ওস্তাদ বললেন, ছাগল নিয়ে বাজারে যাওয়ার আগে একটা দোয়া শেখে যাও। আমি তোমাকে লিখে দিচ্ছি। তুমি ভালো করে মুখস্থ করে নাও। ছাগল নিয়ে বাজারে যাওয়ার সময় মনে-মনে এই দোয়াটি জপ করবে। বাজারে গিয়েও জপ করবে। কোনোপ্রকার ভুল হয় না যেন। দোয়াটি হলো,

‘ছাগলের ছাগলামি

মানুষের পাগলামি

ক্ষমা করো হে মাহান আল্লা,

ওজনের হেরফের

দোষ নয় মানুষের

দোষ করে ওজনের পাল্লা।

ভুল যদি করে থাকি

দিই যদি কোনো ফাঁকি

ক্ষমা চায় ছোট এই শিষ্যে,

ওস্তাদ গুরুজন

তাকে আরো দাও ধন

শিষ্যরা অনুগত বিশ্বে।’

গল্প বলতে গিয়ে দাদু ছড়ার মতো ছন্দে-ছন্দে একটি দোয়া শোনালেন। দাদুর মুখে এমন দোয়া শুনে খুব ভালো লাগল। বললাম,

: এটা খুব সুন্দর একটা ছড়া। তাই না দাদু?

: হ্যাঁ, এই দোয়াটি সুন্দর একটা ছড়া। ছড়াটি সাধক তার স্বার্থে রচনা করেছেন। এই ছড়ার বক্তব্য সঠিক নয়। এটা ছোটদের শেখা ঠিক হবে না। আমার আজও মুখস্থ আছে। ভালো ছড়া লিখতে হলে, ভালো ছড়া পড়তে হয়। বেশি-বেশি পড়তে হয়। আমি অনেক ছড়া পড়েছি। অনেক ছড়া আমার মুখস্থ আছে।

: হ্যাঁ দাদু, তোমার ছড়ার বই আমি পড়ি। গল্পও পড়ি।

: জানি। তোমার মাঝেও বই পড়ার নেশা আছে। এজন্যই তোমাকে আমি এত পছন্দ করি। এত গল্প শোনাই। ছড়া শোনাই।

: আজকের গল্পটিও খুব ভালো লাগছে দাদু। তুমি বলো দাদু। আমি ধৈর্য ধরতে পারছি না।

: হ্যাঁ শুনো...

মিজান দোয়াটি মুখস্থ করে নিল। ছাগল নিয়ে বাজারে যেতে মনে-মনে জপ করল। বাজারে গিয়েও জপ করছে। অনেকেই ছাগলের দাম জিজ্ঞেস করলেন। একজন ছাগল কিনলেন। মিজান বলল, আপনি একটা রশি আনেন। আমার রশিটা আপনাকে দিতে পারছি না। এটা অন্যজনের রশি তাকে ফেরত দিতে হবে।

মিজান মিথ্যে কথা বলল। মিথ্যে না বলে উপায় নেই। ওস্তাদকে খুশি করতে হবে। মিথ্যে কথা বলে, মিজান মনে-মনে খুব অনুতপ্ত হলো। ক্রেতা অন্য একটা রশি এনে ছাগল নিয়ে চলে গেল।

মিজান ছাগল বিক্রি করে ছাগলের রশি আর টাকা নিয়ে ওস্তাদের কাছে গেল। টাকা আর রশি ওস্তাদের হাতে দিল। ওস্তাদ মিজানের কাজে খুশি হলেন। পরেরদিন সকালেই ছাগলটি আবার ওস্তাদের বাড়িতে ফিরে এলো। বিক্রি করা ছাগল ফিরে এসেছে দেখে মিজান খুব অবাক হলো। শুধু অবাক নয় কষ্টও পেল মনে-মনে। কষ্ট পাওয়ারই কথা। এটা খুবই খারাপ কাজ। তার ওস্তাদ জাদুমন্ত্র করে মানুষকে ঠকান। তিনি নাকি বড় মাওলানা। বড় সাধক। মিজান কষ্ট পেলেও ওস্তাদ খুশি হলেন। তিনি মিজানকে ডেকে সামান্য কিছু টাকা দিলেন। বললেন, এই টাকাটা তোমার মাকে দিয়ো। বলবে আমি তোমাকে দিয়েছি। কীভাবে এই টাকা আমরা রোজগার করেছি সেটা কিন্তু ভুলেও তোমার মাকে বলবে না। যদি বলো, যদি মানুষের কানে আমাদের এসব কথা যায় তাহলে তোমার জন্য বিপদ হবে। আমি তোমার কাছ থেকে সব মন্ত্রগুণ কেড়ে নেব। তোমাকেও মন্ত্র দিয়ে ছাগল বানিয়ে রাখব। ওস্তাদের কথা শুনে, মিজান খুব ভয় পেল। মনে-মনে ভাবল, আমি এতগুলো বছর ওস্তাদের বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করলাম। জ্ঞান অর্জন করলাম। ওস্তাদ আমাকে খুব বিশ্বাস ও আদর করে কত মন্ত্র শেখালেন। আমাকে পড়াশোনা করানোর সময় বলছেন, বড় হয়ে মানুষের উপকার করতে। এই বুঝি ওস্তাদের সাধুগিরি? এই বুঝি মানুষকে উপকারের নমুনা? আমার ওস্তাদ কি তাহলে ভালো মানুষ নন? উনি কি কোনো মাওলানা নন? উনি কি মাওলানার লেবাস পরেন লোকদেখানোর জন্য? উনি আসলে কোনো মাওলানা নন। উনি মূলত একজন জাদুকর। ভেতরে- ভেতরে খুবই খারাপ মানুষ। মানুষকে ঠকিয়ে, মিথ্যে বলে, এতগুলো টাকা এনে দিলাম। আর আমাকে ফকিরের মতো সামান্য কটা টাকা দিলেন? মিজান মনে-মনে খুব কষ্ট পেল। কষ্ট পেলেও কিছু করার নেই। আপাতত ওস্তাদের কথামতোই চলতে হবে। ওস্তাদকে খুশি রেখে আরো দীক্ষা নিতে হবে। মিজান যদি ওস্তাদের প্রিয় হতে পারে, তাহলে ওস্তাদ খুশি হয়ে তাকে আরো শক্তিশালী মন্ত্র শেখাবেন। মিজান মনে-মনে ভাবল, সে আরো অনেক মন্ত্র শেখবে। আরো শক্তিশালী মন্ত্র জানতে পারলে, ওস্তাদের খারাপ কাজের প্রতিবাদ করতে পারবে।

মিজান একইভাবে কোনো দিন ছাগল, কোনো দিন ভেড়া, কোনো দিন গরু, কোনো দিন মহিষ নিয়ে বাজারে যায়। বিক্রি করে। টাকা আর রশি এনে ওস্তাদকে দেয়। পরেরদিন বিক্রি করা পশুটি ওস্তাদের বাড়িতে ফিরে আসে। ওস্তাদ তাকে সামান্য টাকা দেন। ওস্তাদের এই অবিচারে মিজান মনে-মনে প্রতিবাদী হওয়ার পণ করে। মনে-মনে প্রতিজ্ঞা করে, এমন ওস্তাদকে ভাগে পেলে সব মন্ত্র শেখে নেবে। কিন্তু কীভাবে ভাগে পাবে? কীভাবে ওস্তাদের সঙ্গে পেরে উঠবে? ওস্তাদ তো সব মন্ত্র তাকে শেখাননি। তাই তাকে এখন ওস্তাদের অনুগত হয়েই থাকতে হবে। তাকে আরো মন্ত্র জানতে হবে। মিজান সৎ থাকতে চায়। ভালো কাজ করতে চায়। আল্লাহর কাছে প্রিয় হতে চায়। মানুষের কাছে প্রিয় হতে চায়। মিজান বিশ্বাস করে, আল্লাহ তাকে সাহায্য করবেন। আর সেদিন ওস্তাদকে প্রতিজ্ঞা করাবে তিনি যেন আর কোনো মানুষের ক্ষতি না করেন। আর যেন কোনো দিন কাউকে না ঠকান। সে বুঝতে পেরেছে ওস্তাদ সব মন্ত্র তাকে শেখাননি। শেখালে উনি ধরা খেয়ে যাবেন। তাই মিজানও মহান আল্লাহকে স্মরণ করে মনে-মনে একটা মন্ত্র সাধন করল। মিজান বিশ্বাস করে মনে-প্রাণে আল্লাহকে ডাকলে, আল্লাহ সাহায্য করবেন। তার মন্ত্রটি হলো,

‘ছুঁ মন্তর ছুঁ...

আল্লার নাম জপ করিয়া ফুঁ...

আল্লা তুমি দাও তাড়িয়ে এই জগতের কু।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close