রেজাউল করিম খোকন

  ০৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

অহংকারী রাজকন্যা

শোভনপুর রাজ্যের রাজকন্যা দীপিকা দেখতে অনেক সুন্দরী। নিজের রূপ নিয়ে অনেক অহংকার তার। কাউকে পাত্তা দিতে চায় না। সবার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে সব সময়। যখন-তখন সবাইকে অপমান করে। তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে কথা বলাটা তার অভ্যাস হয়ে গেছে। রাজকন্যা বলে কেউ তার সামনে কিছু বলে না ভয়ে। কিন্তু সবাই মনে মনে ভীষণ ঘৃণা করে তাকে। রাজা নন্দন কুমারও মেয়ের অহংকারী স্বভাবের কারণে বিব্রত এবং চিন্তিত। রাজকন্যাকে কীভাবে বিয়ে দেবেন, বিয়ের পর মেয়েটি সংসার করবে কীভাবে ইত্যাদি চিন্তায় অস্থির তিনি। আশপাশের বিভিন্ন রাজ্যের রাজপুত্ররা একে একে দীপিকাকে দেখতে এসে তার রূপে মুগ্ধ হলেও তার হিংসুটে, দাম্ভিক আচরণে অপমানিত, লাঞ্ছিত হয়ে ফিরে গেছে। তাকে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা রাজপুত্রদের কারো চেহারা নিয়ে, কারো পোশাক নিয়ে আবার কারো শারীরিক গঠন নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করায় তারা সবাই রাগ করে হতাশ হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। কেউ রাজকন্যা দীপিকাকে বিয়ে করার ব্যাপারে আগ্রহী হয়নি।

হঠাৎ এক দিন রাজকন্যা তার প্রিয় বাগানটিতে ঘুরতে গিয়ে দেখে সব গাছ, লতাপাতা, ফুল শুকিয়ে ম্লান হয়ে পড়ে আছে। অথচ কয়েক দিন আগেও বাগানটি ফুলে-ফলে ঝলমল করছিল। গাছে গাছে পাখি গান গাইত তখন। ফুলে-ফলে ঝলমল করত। রঙিন প্রজাপতির দল উড়ে বেড়াত। পুকুরঘাটে বড় বড় রাজহাঁস মনের আনন্দে নাচানাচি করত। পুকুরে হরেক রকমের মাছের ছোটাছুটি দেখে যে কারো মনটা ভরে যেত। অথচ হঠাৎ করে সবকিছুই কেমন বিবর্ণ, মলিন এবং বিমর্ষ হয়ে গেছে। মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে পুরো বাগান।

অহংকারী রাজকন্যা শুধু মানুষের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেই ক্ষ্যান্ত ছিল না। বাগানের ফুল, গাছ, লতাপাতা, পাখি, পুকুরে ঘুরে বেড়ানো রং-বেরঙের মাছের সৌন্দর্য দেখে হিংসা করে ঠোঁট বাকিয়ে বলত, আমার চেয়ে তোমরা কেউ বেশি সুন্দর হতে পারো না। আমি এই বাগানে, এই পুকুরঘাটে আসি বলেই সবকিছুই আমার সৌন্দর্যে আকর্ষণীয়, সুন্দর হয়ে ওঠে। আমাকে ছাড়া তোমাদের কোনো মূল্য নেই। আমার উপস্থিতিই তোমাদের সুন্দর করে তোলে।

দীপিকার তেমন অহংকারী কথা শুনতে শুনতে বাগানের ফুল, গাছ, লতাপাতা, পাখি, পুকুরের মাছ- সবাই ভীষণ দুঃখ পেয়ে, অভিমান করে হঠাৎ করেই ঝরে পড়েছে, নেতিয়ে পড়েছে। নতুন করে আর কোনো ফুল ফুটছে না। পুকুরের পানি শুকিয়ে যাওয়ায় মাছগুলো কোথায় যেন আড়ালে চলে গেছে। সুন্দর রাজহাঁসগুলো মুখ ভার করে দূরে গিয়ে বসে আছে। পুরো জায়গাটা হঠাৎ করে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে যেন। মনে হয়, প্রচণ্ড ঝড়ে সবকিছু ল-ভ- হয়ে গেছে। নিজের প্রিয় বাগানের দুরবস্থা দেখে সহ্য করতে পারে না রাজকন্যা। প্রচণ্ড মন খারাপ হয়ে যায় তার। বাগান ছেড়ে রাজপ্রাসাদে ফিরে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে কাঁদতে থাকে দীপিকা।

তখন ভিনদেশি অচেনা এক রাজকুমার এসে হাজির হয় রাজপ্রাসাদে। সুদর্শন, সুঠামদেহী রাজকুমার নিজের পরিচয় দিয়ে রাজা নন্দন কুমারকে জানায়, আমার নাম অর্জুন, শান্তিনগর রাজ্যের রাজকুমার আমি। আমি রাজকন্যা দীপিকাকে বিয়ে করতে আগ্রহী। এর আগে অনেকেই তাকে বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানালেও দীপিকাকে বিয়ে করতে চায় সে। রাজকুমারের প্রস্তাব শুনে রাজা মহাখুশি হন। রাজকন্যা দীপিকাও অবাক হয় নতুন আসা অচেনা রাজকুমারের ইচ্ছের কথা শুনে। তার অহংকারী, দাম্ভিক, হিংসুটে আচরণের কারণে সবাই যেখানে প্রত্যাখ্যান করেছে সেখানে রাজকুমার অর্জুন তাকে বিয়ে করতে চাইছে। রাজকুমার তাকে বলে, শুনেছি, তোমার নাকি চমৎকার সুন্দর, সাজানো-গোছানো বাগান রয়েছে, সেখানে পুকুরঘাটে রাজহাঁসরা লুটোপুটি খায়, নাচে। পাখিরা মিষ্টি গান গায়। রাজকন্যা, আমি তোমার সেই সুন্দর বাগানটি ঘুরে দেখতে চাই।

পাণিপ্রার্থী সুদর্শন রাজকুমারের কথা শুনে বিব্রত হয় রাজকন্যা। যে সুন্দর বাগান দেখতে সে কৌতূহলী হয়েছে, বাগানের অবস্থা এখন তো আগের মতো নেই। সব সৌন্দর্য হারিয়ে ল-ভ-, বিধ্বস্ত হয়ে আছে। সেখানে রাজকুমারকে নিয়ে গেলে অপমানিত, লজ্জিত হতে হবে। দীপিকা নানাভাবে এড়াতে চাইলেও অনেকটা জোর করেই রাজকুমার তাকে সঙ্গে নিয়ে বাগান দেখতে যায়। সেখানে গিয়ে বাগানের মলিন, করুণদশা দেখে দুঃখ প্রকাশ করে সে। তারপর বলে, রাজকন্যা, তোমার বাগান যেদিন আবার সুন্দর হয়ে উঠবে, ফুলে-ফলে, লতাপাতায় রঙিন সাজে সেজে উঠবে, গাছে গাছে পাখিরা গাইবে সেদিন আমি তোমাকে বিয়ে করব। দুঃখিত, এখন আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারছি না। আমাকে ক্ষমা করো তুমি।

রাজকুমার অর্জুন চলে গেলে দীপিকা আবার কান্নায় ভেঙে পড়ে। এত চমৎকার, সুদর্শন একজন রাজকুমার শেষ পর্যন্ত তাকে বিয়ে করতে রাজি হলেও তার অনেক শখের সুন্দর বাগানের করুণদশা দেখে হতাশ হয়ে ফিরে গেছে। যদি বাগানটি আবার আগের মতো উজ্জ্বলভাবে ফুলে-ফলে সুন্দর হয়ে, সজ্জিত হয়ে হেসে ওঠে, তাহলে রাজকুমার তাকে বিয়ে করতে রাজি আছে বলে গেছে। তার এই কঠিন শর্ত এখন পূরণ করবে সে কীভাবে? দীপিকা একাকী বসে ভাবতে থাকে তার শখের বিখ্যাত বাগানের দুরবস্থা হলো কেন? এজন্য দায়ী কে? অনেকক্ষণ চিন্তাভাবনা শেষে তার উপলব্ধি হয়, তার অহংকারী, দাম্ভিক মনোভাব ও কথাবার্তার কারণে বাগানের গাছ, লতাপাতা, ফুল-ফল, পাখি, পুকুরের ভেসে বেড়ানো রাজহাঁস, মাছ সবাই আর ওপর অভিমান করেছে। তারা অনেক কষ্ট পেয়ে ঝরে পড়েছে, শুকিয়ে গেছে। সবকিছুই মলিন, স্থবির হয়ে গেছে।

এসব কিছুর জন্য সে নিজেই একমাত্র দায়ী। তার দাম্ভিক স্বভাব, অহংকারী আচরণ, কথাবার্তা সবই চরমে পৌঁছেছিল। যা সহ্য করতে না পেরে বাগানের গাছ, লতাপাতা, ফুল-ফল, পাখি সবাই স্তব্ধ, নিথর হয়ে গেছে। তারা হাসতে ভুলে গেছে, গান গাওয়া ছেড়ে নীরব হয়ে গেছে। এ জায়গায় এলে দুঃখণ্ডশোকে ভারী হয়ে উঠছে মনপ্রাণ। এবার রাজকন্যা তার নিজের এত দিনের সব ভুল বুঝতে পারে। তার অহংকারী স্বভাব, দাম্ভিক আচরণে আশপাশের সবাই অসন্তুষ্ট, ক্ষুব্ধ। কেউ তাকে পছন্দ করে না। মন থেকে ভালোবাসে না। রাজকন্যা বলে সামনে কেউ কিছু বলে না তাকে। নীরবে মুখ বুজে সহ্য করে যায়। কিন্তু তার আচরণে অভিমান করে ক্ষুব্ধ হয়ে তার সুন্দর বাগানটি ধ্বংসের মুখোমুখি হয়েছে আজ। অভিশাপ নেমে এসেছে সেখানে।

সঙ্গে সঙ্গে দীপিকা ছুটে যায় তার অনেক শখের বাগানে। প্রতিটি গাছের সামনে গিয়ে তাদের দুহাতে জড়িয়ে ধরে অঝোর কান্নায় ভেঙে পড়ে সে। ‘তোমরা আমার কথায়, আচরণে অনেক কষ্ট পেয়েছো, অভিমান করেছো। আমার ওপর রাগ করে ঝরে পড়েছো। শুকিয়ে ম্লান হয়ে গেছো। এভাবে পুরো বাগানের সৌন্দর্য হারিয়ে কুৎসিত হয়ে উঠেছে জায়গাটা। আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি আমার সব ভুল বুঝতে পেরেছি। রাজার মেয়ে বলে অহংকারে আমি অমানুষ হয়ে গিয়েছিলাম। মানবিক হওয়ার মধ্যেই একজন মানুষের আসল মনুষ্যত্ব ফুটে ওঠে, তার সৌন্দর্য সেখানেই লুকিয়ে থাকে। আমি দেখতে সুন্দরী বলেই দাম্ভিকতা, অহংকার বাসা বেঁধেছিল মনে, যা আমাকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। আমি এখন আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। দয়া করে তোমরা সবাই আমাকে ক্ষমা করো।

রাজকন্যা দীপিকার আর্তনাদ আর কান্নায় আকাশ-বাতাস, প্রকৃতি সবই ভারী হয়ে ওঠে। বাগানের গাছ, লতাণ্ডপাতা, ফুল-পাখি, পুকুরের পানি, মাছ, হাঁস- সবাই অভিমান, দুঃখ, রাগ ভুলে গিয়ে আবার হেসে ওঠে। ধীরে ধীরে জেগে ওঠে সবকিছু। প্রাণ ফিরে পায় পুরো বাগান। উজ্জ্বল ঝলমলে রঙিন সাজে সেজে ওঠে। পাখিরা গাছে গাছে মিষ্টি সুরে গান গাইতে শুরু করে।

রাজকন্যা দীপিকার বাগান ফুলে-ফলে আবার আগের মতো সৌন্দর্য নিয়ে জেগে ওঠার খবর পেয়ে তা দেখতে পঙ্খিরাজ ঘোড়ায় চড়ে রাজকুমার অর্জুন ছুটে আসে। দীপিকা তাকে সঙ্গে নিয়ে পুরো বাগানটি দেখায়। এবার রাজকুমার দীপিকার বাগানের অপরূপ সৌন্দর্যে চমকে ওঠে, মুগ্ধ হয়। তার চেহারায় আনন্দ উচ্ছ্বাস ফুটে ওঠে। আবেগে, আনন্দে, ভালোবাসার উচ্ছ্বাসে রাজকন্যার দুহাত জড়িয়ে ধরে। ‘রাজকন্যা, তোমার বাগান ফুলে-ফলে সৌন্দর্যে আবার হেসে উঠেছে। আমি অনেক মুগ্ধ হয়েছি। আমার ভীষণ ভালো লাগছে। তুমি তোমার মনে চেপে বসা অহংকার, হিংসা, দাম্ভিকতা সব ত্যাগ করে সত্যিকার ভালো মানুষ হয়ে উঠেছো। এবার তোমাকে বিয়ে করতে, আমার কোনো আপত্তি নেই। আমি আজই তোমাকে বিয়ে করতে চাই,’ রাজকুমার উচ্ছ্বাস ভরা গলায় কথাগুলো বলে। এরপর মহাধুমধামে রাজকন্যা দীপিকার সঙ্গে শান্তিনগর রাজ্যের রাজকুমার অর্জুনের বিয়ে হয়ে যায়। সাত দিন ধরে দুই রাজ্যজুড়ে আনন্দ উৎসবে মেতে ওঠে সবাই। রাজকন্যা থেকে রাজবধূ হয়ে শান্তিনগর রাজ্যে চলে যায় দীপিকা। একসময় অহংকারী, দাম্ভিক, হিংসুটে, বদমেজাজি হিসেবে সবার অপছন্দের থাকলেও নিজেকে বদলে ফেলা দীপিকা দয়ালু, নম্র-ভদ্র, সহানুভূতিশীল ভালো মানুষ হয়ে ওঠে। সবাই তাকে নতুনভাবে ভালোবাসতে থাকে।

উপদেশ : অহংকার পতনের মূল। অহংকারী হলে পতন এবং ধ্বংস আসবেই। হিংসা, বিদ্বেষ, অহংকার, দাম্ভিকতা মানুষকে অমানুষে পরিণত করে। হিংসা-অহংকার ছেড়ে মানবিক হতে হবে আমাদের সবাইকে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close