নওয়াব নজির

  ২৮ জানুয়ারি, ২০২৩

তরুণের পরিকল্পনা

শীত ঋতু বেড়ানোর সুন্দর সময়। তনয়, তিতু, তিথি আর তানিম মিলে ঠিক করল, তারা প্রচীন ঐতিহ্যের পানাম নগরে ঘুরতে যাবে। সঙ্গে নয়াপুর গ্রামে গিয়ে খেজুরের টাটকা রস খাবে। শীতের ভোরও উপভোগ করবে। ‘শহরে তো শীতই পড়ে না। দু-এক দিন পড়ে, তাও আবার দেখতে দেখতেই শেষ। শীতের দিনে শীত না পড়লে শীতের সৌন্দর্য কিছু হলো!’ তিতু বলে। তিথি মনে করার চেষ্টা করে গত কয়েক বছরের শীতের স্মৃতি কিন্তু তেমন মনে করতে পারে না। অথচ গ্রামে কী সুন্দর শীত পড়ে; কুয়াশা, শিশির, ঘাস, গাছপালা, পিঠাপুলি, উৎসব, আরো কত কি। তনয় তিথির সঙ্গে কথাগুলো যোগ করে। তানিম বলে, গ্রামের সুন্দর গ্রামে, তা কি শহরে পাবে? আবার শহরের সুন্দর শহরে, তা কি গ্রামে পাবে? তাই তো শহরের মানুষ গ্রাম দেখতে যায়, গ্রামের মানুষ শহর দেখতে আসে। এটাই নিয়ম। কথা হলো, কবে বেড়াতে যাব সেটা ঠিক করো। তবে তরুণকে জানাতে হবে। ও আমাদের বন্ধু, ওকে না জানানো ঠিক হবে না।

তরুণকে খুঁজে না পেয়ে সবাই শিমুল মামার কাছে গেল তরুণকে খোঁজ করতে। খোঁজ মিলল না। মামা বললেন, আচ্ছা, তোমরা কী বিষয়ে এসেছো, চাইলে আমাকে বলতে পারো। তানিম জানাল, পানাম নগরে বেড়াতে যাওয়ার কথাটি। শুনে শিমুল মামা খুশি হলেন। তিনি সব সময়ই ভ্রমণের পক্ষে। ভ্রমণকে তিনি পছন্দ করেন। বললেন, যেকোনো ভ্রমণই শিক্ষার অংশ। ক্লাসরুমে বসে, বইপত্র পড়ে, ছবি দেখে যতটা শেখা যায়, তার চেয়ে বেশি শেখা যায় ভ্রমণে। ভ্রমণে মনের চোখ খুলে যায়, দৃষ্টির সীমা বড় হয়। চিন্তাশক্তি বাড়ে। কিন্তু তোমরা যাচ্ছো কবে, আমাকেও নিয়ো কিন্তু। তারিখ ঠিক হয়নি মামা। তরুণের সঙ্গে কথা বলে ঠিক করব ভেবেছি। আপনি আমাদের সঙ্গে গেলে অনেক মজা হবে।

শিমুল মামা দেশ-বিদেশ ভ্রমণ করা মানুষ বলে, তানিম, তিথি, তিতু শিমুল মামাকে সঙ্গে নেওয়ার বিষয়ে মত ঠিক করল। পরের দিন তরুণের সঙ্গে দেখা। তরুণকে পেয়ে তিতুরা কথাটি তুলল। শিমুল মামার সঙ্গে দেখা হওয়ার কথাটিও তরুণকে বলা হলো। সব শুনে তরুণ কিছুক্ষণ চুপ করে কী যেন ভাবতে লাগল। তনয় জিজ্ঞাসা করল, ‘কী ভাবছ তরুণ, আমাদের সঙ্গে কি তোমার যাওয়ার ইচ্ছে নেই?’ ‘না, ঠিক তা নয়।’ তরুণ বলল। ‘তবে?’ তিতু প্রশ্ন। ‘ভ্রমণে যেতে আমার কোনো অসুবিধা নেই, আমিও ভ্রমণ খুব পছন্দ করি। কিন্তু এখন না গিয়ে আর কিছুদিন পর গেলে হয় না?’ তিথি চট করে জানতে চাইল, ‘এখন কী অসুবিধা তরুণ? এটাই তো ভ্রমণের আর শীত দেখার ভালো সময়।’ তরুণ বলল, ‘আমি আসলে একটি পরিকল্পনা নিয়ে ভাবছি, যেখানে তোমরা সবাই আছো। সেখানে কিছু সময়ের প্রয়োজন, কিছু আর্থিক সাহায্য প্রয়োজন। তাই অন্যদিকে মন দিতে চাচ্ছি না।’ ‘ভাবনাটি আমাদের সঙ্গে শেয়ার করতে পারো তরুণ। আমাদের প্রয়োজন হলে আমরা থাকব।’ তিতু বলল।

সবাই তাদের পছন্দের শিমুল মামার কাছে এলো। তরুণ চায় শিমুল মামাই তরুণের পরিকল্পনাটি সবার কাছে বলুক। তানিম এখনো আসেনি, তাই তরুণ কিছু কাগজপত্র ঠিক করে নিল। শিমুল মামা তার ব্যাগ থেকে কয়েকটি ক্যাডবেরি বের করে সবার হাতে দিলেন। কাশ্মীর থেকে আনা। এর মধ্যেই তানিম হাজির। তরুণ শিমুল মামাকে অনুরোধ জানাল শুরু করার জন্য। মামা বললেন, ‘তরুণ, পরিকল্পনাটি যেহেতু তোমার, তুমি বললেই ভালো হয়, বলো।’ তরুণ বলতে শুরু করল, ‘গত বছর পুরো সময়টি স্কুলের টিফিন আর যাতায়াত ভাড়া থেকে কিছু টাকা বাঁচিয়ে আমি মোট চার হাজার টাকা জমিয়েছি। মেজো মামা, ছোটো চাচ্চুু, ফুপ্পিদের কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে উপহার পাওযা আরো কিছু টাকা মিলিয়ে আমার কাছে এখন সাত হাজার টাকা আছে। এই টাকাটি দিয়ে আমি এ বছর বিভিন্ন স্কুলে যেসব শিশু টাকার জন্য শিক্ষা সফরে যেতে পারে না তাদের হাতে ভাগ করে দিতে চাই। আমার সঙ্গে শিমুল মামা আছেন, পাড়ার সাফিন ভাই, সিফাত ভাই আছেন। তোমরাও যদি আমার সাথে থাকো তাহলে আমরা এই কাজটি সুন্দরভাবে শেষ করতে পারব। এবং তোমাদের কাছের কেউ যদি এর সাথে যুক্ত হতে চায় আমরা তাদেরও সাথে নেব। কী বলো তোমরা?

তিথি, তিতু, তনয়, তামিম তরুণের পরিকল্পনাটি শুনে কিছুক্ষণ একে অপরের দিকে তাকাল। কেউ কোনো কথা বলল না। তরুণ তাদের সবার মুখের দিকে তাকিয়ে ঘাবড়ে গেল, ওরা বিষয়টি মন্দভাবে নেয়নি তো! মনে মনে ভাবল। তনয় শিমুল মামার কাছে অনুমতি চাইল, আমরা কি একটু বাইরে যেতে পারি? শিমুল মামা বললেন, পারো। তরুণ কে রেখে বাকিরা বাইরে গেল। তরুণের মুখটি ভার। মামা বললেন, কোনো কিছুতে মন খারাপ করো না। সব কাজের সঙ্গে সবাইকে থাকতেই হবে এমন নয়, কিন্তু কেউ না কেউ থাকবে। ভালো কাজের সঙ্গে থাকে বেশির ভাগ মানুষ, মনে রেখো। তানিম, তিথি, তিতু, তনয় একটু পর ফিরে এলো। তিতু বলল, আমরা ভ্রমণেই যেতে চাই। এ কাজের সাথে থাকতে পারছি না। তিথি বলল, শীত চলে গেলে এরূপ শীত আবার কবে পড়বে আমরা জানি না। তাই ভ্রমণটিই হোক। তনয় ফিসফিস করে বলল, আমাদের ভ্রমণটি আগে হলে ভালো। তানিম চুপ করে রইল। ওদের কথা শুনে শিমুল মামা তরুণের দিকে তাকাল, তরুণ শিমুল মামা দিকে তাকাল। তরুণ কিছু বলল না। তার দুচোখ ঝাপসা হয়ে উঠল।

শিমুল মামা তরুণকে সান্ত¦না দিয়ে কিছু বলতে যাবে এমন সময় তানিম, তিথি, তনয়, তিতু একসঙ্গে হো হো করে হেসে উঠল। চেয়ার থেকে উঠে তরুণকে সবাই জড়িয়ে ধরল, ‘তোমার সঙ্গে আমরা একটু মজা করলাম তরুণ, হা হা হা। শিমুল মামা আপনার সঙ্গেও।’ এবার শিমুল মামাও হেসে উঠলেন। তিতু বলল, ‘তরুণ এমন একটি বিষয়ে পরিকল্পনা করেছে, যার সঙ্গে না থাকা বোকামি। আমরা তরুণের সঙ্গে আছি। এ কাজটি আমাদের দশটি ভ্রমণের চেয়ে ভালো কাজ। কেননা, আমরাও দেখেছি, প্রতি নতুন বছরে অনেক শিশুই স্কুলের শিক্ষা সফরে যেতে পারে না টাকার অভাবে।’ তনয় বলল, ‘মামা, আমরা বাইরে মূলত কথা বলেছি, আমরা কেন তরুণের মতো এমন করে ভাবতে পারলাম না! তরুণ কী সুন্দর একটি বিষয় নিয়ে পরিকল্পনা করেছে। আমরা মনে করি, প্রতিটি শিশুরই এমন কিছু কাজের কথা আগে ভাবা উচিত এবং এমন কাজের সাথে থাকা উচিত।’ এই বলে তার পকেট থেকে ভ্রমণের জন্য মায়ের কাছ থেকে আগেই নেওয়া পুরু টাকাটা তরুণের হাতে তুলে দিল। বাকিরাও দেবে বলল। শিমুল মামা পকেট থেকে একটা এক হাজার টাকার চকচকে নোট বের করে বললেন, তরুণের পরিকল্পনায় এটা হলো আমার সামান্য অংশগ্রহণ...

সঙ্গে সঙ্গেই রুমের তিন দিক করতালি বাজতে লাগল।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close