আবদুস সালাম

  ২৬ নভেম্বর, ২০২২

গ্রামের মুয়াজ

মইদুল সাহেব গ্রামেই বড় হয়েছেন। গ্রামের মাটি ও মানুষ তার রক্ত-মাংসের সঙ্গে মিশে আছে। শিক্ষকতা তার পেশা। প্রতিদিন ১০ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে তাকে স্কুলে যেতে হয়। তবুও শহর তাকে টানে না। গ্রামেই সে সপরিবারে বসবাস করেন। একজন সৎ ও জনদরদি ব্যক্তি হিসেবে গ্রামে তার সুনাম রয়েছে। সবার বিপদণ্ডআপদে এগিয়ে আসেন। সাধ্যমতো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। গ্রামের মজনু একজন হতদরিদ্র কৃষক। বড় ছেলে মুয়াজ একজন মেধাবী ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও লেখাপড়ার খরচ দিতে পারেন না। বাপবেটা দুজনা খেতখামারে কাজ করেন। মাঠে যাওয়ার সময় এক দিন মইদুল সাহেবেন সঙ্গে তার দেখা হয়ে যায়। মা মরা ছোট্ট মুয়াজকে দেখে মইদুলের কষ্ট হয়। কথা না বাড়িয়ে মইদুল সাহেব মজনুকে সন্ধ্যার পর দেখা করতে বলেন।

যথাসময়ে মজনু মইদুল সাহেবের সঙ্গে দেখা করে। শারীরিক খোঁজখবর নেওয়ার পর ছেলের লেখাপড়ার খোঁজ নেন। ছেলের পড়ালেখার কথা জানতে চাওয়ায় মজনু লাজনত বদনে বলে, ‘আমরা গরিব মানুষ। দিন আনি দিন খাই। ছেলেকে কীভাবে পড়াব? ওকে পড়াতে হলে যে শহরে পাঠাতে হবে। আমাদের গ্রামে যদি হাইস্কুল থাকত তাহলে ওকে ভর্তি করে দিতাম।’ ‘এক কাজ করো। মুয়াজকে আমার স্কুলে ভর্তি করে দাও। ওর পড়ালেখার সব খরচ আমি দেব। খরচ নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। পরে যদি কোনো সমস্যা হয় তখন দেখা যাবে। আপাতত পড়তে থাকুক।’ মজনু সুযোগটা হাতছাড়া করেনি। সে মাস্টার সাহেবের কথায় রাজি হয়ে যায়। পড়ালেখার সুযোগ পেয়ে মুয়াজ খুব খুশি হয়। মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করতে থাকে।

মুয়াজের সমবয়সি মইদুল সাহেবের একটা ছেলে আছে। নাম সোহাগ। একই ক্লাসে না পড়লেও দুজনার মধ্যে সখ্য গড়ে ওঠে। ওদের বন্ধুত্ব দেখে মইদুল সাহেব খুশি হন। নিজের ছেলের মতো তিনি মুয়াজের পড়ালেখার দায়িত্ব নেন। মুয়াজের প্রাইভেট পড়ার খরচও দেন তিনি। ফলে ভালোভাবে পাস করে মুয়াজ ওপর ক্লাসে উঠতে থাকে। এভাবেই চলে সাতটি বছর। মুয়াজের এইচএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট খুব ভালো হয়। সোহাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পায়নি ঠিকই কিন্তু মুয়াজ পেয়েছে। তবুও মইদুল সাহেব ও তার পরিবার মুয়াজের বাবা-মায়ের মতো খুশি হয়। অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির মাস-ছয়েক পর থেকে মুয়াজকে আর খরচ দিতে হয়নি। টিউশনি করে নিজের পড়ার খরচ জোগাত। একসময় মুয়াজের পড়ালেখাও শেষ হয়ে যায়। চাকরি খুঁজতে থাকে। অবশেষে যে শহরে সে পড়ালেখা করেছে সেই শহরে একটা বেসরকারি কলেজে প্রভাষকের চাকরি পেয়ে যায়। মইদুল সাহেবের মতো সেও গ্রামে থেকে যায়। গ্রাম থেকেই কলেজে যাতায়াত করে।

মুয়াজও দরিদ্র ছেলেমেয়েদের পাশে দাঁড়িয়েছে। তাদের প্রতি সাধ্যমতো তার সাহায্যের হাত প্রসারিত করেছে। তার কাছে প্রাইভেট পড়তে এলে সে কারোর কাছে টাকা নেয় না। নানান কারণে গ্রামবাসী মুয়াজকে নিয়ে গর্ব করে। বাবা মজনু আজ বেঁচে থাকলে নিশ্চয় খুশি হতো। অবশ্য মুয়াজ নিজের পিতার মতোই মইদুল সাহেবকে শ্রদ্ধা করে। তার প্রতি সে চির কৃতজ্ঞ। কোনো দিন তার ঋণ শোধ হবে না। বছর-চারেক পর মইদুল সাহেব অসুস্থ হয়ে পড়ে। তার পুরাতন কিডনি রোগটি আবার ধরা পড়ে। স্থানীয় চিকিৎসকরা কোনোভাবেই ভালো করতে পারে না। চিকিৎসকের পরামর্শে মইদুল সাহেবকে ঢাকায় নেওয়া হয়। ডাক্তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেছে তার কিডনি কাজ করছে না। হাসপাতালে বসে মইদুল বুঝতে পারে তার সময় শেষ। মৃত্যুর তার দুয়ারে কড়া নাড়ছে। যেকোনো সময় তার প্রাণবায়ুটা বের হয়ে যাবে। সবাই তাকে আল্লাহকে স্মরণ করতে বলে। তাকে সান্ত¡না দেওয়ার ভাষা যেন আজ কারোর জানা নেই।

মইদুল সাহেব যখন মৃত্যুশয্যায়। ঠিক তখন মুয়াজ তার পাশে বসে দোয়া পাঠ করে। তাকে সান্ত¡না দিয়ে বলে আপনার কিছু হয়নি। দেখবেন আপনি দ্রুত সুস্থ হয়ে যাবেন। ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে মইদুল বলে, ‘আমার তো দুটো কিডনিই শেষ আমি কী করে বাঁচব?’ ‘ও নিয়ে আপনি একদম ভাববেন না। প্রয়োজন হলে আমার একটা কিডনি দিয়ে দেব। আপনার কিচ্ছু হবে না।’ ‘নারে বাবা তুই ওই কাজ করিস নে। বয়স হয়েছে। কদিনই বা বাঁচব। আমার জন্য দোয়া করিস। গ্রামের সহজ-সরল মানুষদের পাশে পাশে থাকবি। ওদের ভুলবি না। ওরা খুব খুশি হবে।’ মুয়াজ কথা দিয়েছিল। তার কথাগুলো মইদুলের মনের মধ্যে গেঁথে যায়। কিডনি দানের কথাগুলোও তার কানে প্রতিধ্বনি হচ্ছে বারবার। মইদুলের চোখমুখে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। সে অন্তরে প্রশান্তি অনুভব করে। কেমন যেন সুস্থতা বোধ করে। অবশ্য নিয়তি তাকে বেশি দিন সুস্থ থাকতে দেয়নি। এক দিন পরই পরপারে তার স্থায়ী ঠিকানায় ফিরে যায়। মুয়াজ সত্যি সত্যিই তার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করেছিল। গ্রামই ছিল তার শেষ ঠিকানা। গ্রামবাসীর সুখণ্ডদুঃখই ছিল তার সুখ-দুঃখ।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close