জুয়েল আশরাফ

  ০৮ অক্টোবর, ২০২২

পিলুর পরীক্ষা

সাত বছরের জুবাইদাকে বাড়ির কেউ বাগ মানাতে পারছে না। সব সময়ই সে চঞ্চল। তার কাণ্ডকারখানা দেখে বাড়িতে হতাশ সবাই। পরীক্ষা এসে গেছে! তার মধ্যেই সে চূড়ান্ত অমনোযোগী। কোনো কথা তাকে বোঝাতেও সময় লাগে। উপরন্তু তার বায়না সামলাতে নাজেহাল সবাই।

জুবাইদার বাবা আলাউদ্দিন সাহেব বললেন, এমনি দেখলে মনে হবে, এসব নেহায়েতই দস্যিপনা। ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে।

জুবাইদার মা বললেন, মেয়ের দিকে ভালো করে একটু নজর দিয়ে দেখো, সমস্যা আরো গভীর।

নজর করতে গিয়ে আলাউদ্দিন সাহেব দেখেন, জুবাইদা বারান্দায় মেঝেতে বসে মাথা নিচু করে একা একা কথা বলছে। এ বয়সের শিশুরা একা কথা বলার অভ্যাস রাখে তা তিনি জানেন। ছোটবেলায় তিনিও একা একা কথা বলতেন। তাই মেয়েকে নিয়ে মোটেই বিচলিত হলেন না। কিন্তু জুবাইদার মা বোঝাচ্ছিলেন, মাঝেমধ্যেই জুবাইদা এমন করে, বারান্দায় এলেই একা একা কথা বলে।

আসলে জুবাইদা একা একা কথা বলে না, অথবা বলছে না। সে কথা বলছে পিলুর সঙ্গে। পিলু হচ্ছে একজন কিশোরী পিঁপড়া। পিঁপড়াটাই জানিয়েছে তার নাম পিলু। পিলু থাকে বারান্দায় গোলাপ গাছটির টবের পাশে। বাবা মায়ের সঙ্গে। সাত মাস হলো জুবাইদার সঙ্গে পরিচয়। কোনো সমস্যায় পড়লেই সে জুবাইদার কাছে পরামর্শ চায়। তার ধারণা জুবাইদা খুবই বুদ্ধিমতী মেয়ে। আজ সে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ের ওপর কথা বলছে। দুজনেই খুব চিন্তিত।

আলাউদ্দিন সাহেব মেয়ের কাছে এগিয়ে এলেন। বললেন, কার সঙ্গে কথা বলছিস মা?

জুবাইদা বলল, জানো বাবা পিলুর কাল অঙ্ক পরীক্ষা। সে অঙ্ক করতে পারছে না।

আলাউদ্দিন সাহেব ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, পিলুটা কে?

জুবাইদা বলল, মেয়ে-পিঁপড়া বাবা। আমাদের বারান্দায় থাকে। আমার সঙ্গে রোজ কথা বলে।

আলাউদ্দিন সাহেব হতভম্ব গলায় বললেন, আমাদের বারান্দার পিঁপড়া তোমার সঙ্গে কথা বলে?

জুবাইদা মাথা দুলিয়ে বলল, হ্যাঁ বাবা।

আলাউদ্দিন সাহেব বিরক্ত হয়ে মেয়েকে কোলে নিয়ে ঘরে এনে বিছানায় নামিয়ে দিলেন। এখন মেয়ের সঙ্গে দুষ্টুমির সময় নয়। অফিসে যাবেন তিনি। অফিস যাওয়ার মুহূর্তে দুষ্টুমিতে যোগ দিলে মেয়ের পড়াশোনার ক্ষতি। দু-চারটি কঠিন কথা বলে পড়াতে বসিয়ে চলে যাবেন। অবশ্য জুবাইদাকে কঠিন কথা বলতে তিনি পারেন না। কঠিনের অভিনয় করেন শুধু। যখনই জুবাইদাকে শাসন করতে চান তার হাসি আসে। হাসি লুকিয়ে শাসন করতে হয়।

জুবাইদা হাই তুলতে তুলতে বলল, আমি এখন পড়তে বসব না বাবা।

আলাউদ্দিন সাহেব বললেন, আমি অফিসে চলে গেলে তোমার আম্মু তোমাকে মারতে পারে। তাই আমি থাকতেই পড়াশোনার জন্য রেডি হও।

কী ভেবে একটু পর ভুরু কুঁচকে জুবাইদা জানতে চাইল, আচ্ছা বাবা, পিলুর জন্য ভালো একজন অঙ্ক টিচার দরকার। ওদের অঙ্ক টিচারটা ফাঁকিবাজ। ঠিকমতো অঙ্ক বুঝিয়ে দেয় না। পড়ানোর সময় মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত থাকে। তুমি কি পিঁপড়া-সমাজে একটু খোঁজ নেবে অঙ্কের ভালো টিচার পাওয়া যায় কি না?

যেন কিছুই শুনতে পাননি, এমন ভঙ্গিতে আলাউদ্দিন সাহেব বই-খাতাণ্ডপেনসিল বিছানায় এনে দিয়ে বললেন, আমি অফিসে যাচ্ছি। ফিরে এসে যেন শুনি ঠিকমতো পড়েছো।

তৈরি হয়ে বাবা বেরিয়ে গেলেন। বাবার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে জুবাইদা বড় করে শ্বাস ফেলল। ঠিক তখনই পিল পিল পায়ে জুবাইদার হাতের আঙুল বেয়ে উঠে এলো বড়সড় একটি ডেঁয়ো লাল পিঁপড়া। পেটের অংশটা মোটা। দুই পাশে মাথা নাচিয়ে বলল, আমি আগেই বলেছিলাম তোমরা মানুষরা আমাদের পিঁপড়া-সমাজের কোনো উপকারই করতে পারবে না।

জুবাইদা দুঃখী ভঙ্গিতে বলল, আমাকে একটু ভাবতে দাও পিলু। তোমার অঙ্ক পরীক্ষার সমাধান খুঁজে বের করব।

পিলু অনুযোগের সুরে বলল, ভেবে ভেবে কী আর সমাধান করবে? আমাদের পরীক্ষার সময় এসে গেছে। এবারও যদি ফেইল করি পিঁপড়া-সমাজে কি মুখ দেখাতে পারব?

জুবাইদা বলল, বা রে, পরীক্ষা শুধু তোমার একার না। আমারও তো পরীক্ষা সামনে। আমিও যদি ফেইল করি আম্মু কী আমাকে ছেড়ে দেবে?

পিলু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, এখন তাহলে উপায়?

জুবাইদা বলল, উপায় একটা আছে। অঙ্ক স্যার টঙ্ক স্যার চিন্তা বাদ। পরিবারে যারা অঙ্ক ভালো বুঝে তাদের কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে পড়াশোনা আরম্ভ করো। অথবা বন্ধুদের সাহায্য নাও।

পিলু ভালো উপদেশ পেয়ে মাথা নাচিয়ে, ফোলা পেট দুলিয়ে পিলপিল পায়ে চলে গেল। দরজার আড়াল থেকে জুবাইদার আম্মু এতক্ষণ মেয়ের সব কথা শুনেছেন। তিনি প্রস্তুতি নিয়ে ছিলেন, আজ জুবাইদাকে একা একা কথা বলার কারণে প্রচণ্ড ধমক দেবেন। কিন্তু মেয়েকে বই নিয়ে পড়াশোনায় মনোযোগী হতে দেখে খুশি হয়ে রান্নাঘরে চলে গেলেন।

পরীক্ষার দুদিন আগে শরীর কাঁপিয়ে প্রচণ্ড জ্বর এলো জুবাইদার। আব্বু আম্মু দুজনেই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তাকে নিয়ে। বাবা অফিসে সময় কম দিয়ে বাড়িতেই থাকলেন। সারারাত আম্মু মাথায় পানিপট্টি দিয়ে জেগে থাকেন। খুব চিন্তা হলো তার। পরীক্ষার সময় জ্বর!

পরের দিন বিকেলে পিলু এলো জুবাইদার কানের কাছে। খুশি গলায় বলল, আমার পরীক্ষা ভালো হয়েছে। কিন্তু মনটা খারাপ তোমার জ্বর। আমি প্রার্থনা করব আল্লাহ তোমাকে সুস্থ করে দিন।

রাতেই জ্বর ছেড়ে গেল। ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে জুবাইদা ঝেড়ে লাফিয়ে উঠল, যেন জ্বরই ছিল না কখনো। আব্বু আম্মু দুজনেই চিন্তামুক্ত হলেন। জুবাইদা বই-খাতা নিয়ে বসল। কাল পরীক্ষা। পড়াশোনায় মনোযোগী হলো সে। একটি ভালো রেজাল্ট তাকে করতেই হবে পিলুর মতো।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close