সাজ্জাদ সিয়াম
পিহু এবং অমি

পুজোর ছুটিতে অমির স্কুল বেশ কিছুদিন বন্ধ। তাই অমি মায়ের কাছে গ্রামে নানুবাড়ি যাওয়ার জন্য বায়না ধরেছে। অনেক কান্নাকাটির পর বাবা রাজি হয়েছেন। ট্রেনের ঝকাঝক শব্দ আর শরতের সাদা সাদা তুলোর মতো মেঘে কল্পনায় রাজারানি রাজ্য এসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েছে অমি। যখন সান্তাহার স্টেশনে ট্রেন এসে দাঁড়ায় তখন মা অমিকে ডেকে বলেন, ‘এই অমি, ওঠো। আমরা স্টেশনে চলে এসেছি। এখনই নামতে হবে।’ অমি মহাখুশি কত দিন পর নানুবাড়ি আসছে! অমিরা নানুবাড়িতে চলে এসেছে। নানু-নানি অমিকে জিজ্ঞাসা করছে, কেমন আছো নানু ভাই? আদর করে কোলে তুলে নিচ্ছে। চুমু খাচ্ছে। কিন্তু অমির মন পড়ে আছে নানুর ফুলবাগানে ওর বন্ধু পিহুর কাছে। পিহু একটি রঙিন প্রজাপতির নাম। ওর ডানার বাহারি আলপনা অমির ভীষণ প্রিয়। একবার শীতের সকালে পিহুর ডানায় জমা শিশিরগুলো রোদের আলোয় মুক্তর মতো জ্বলজ্বল করছিল, যা দেখতে অমির এত ভালো লেগেছিল যে সে সব সময় ওগুলো মিস করে। ওর কাছে নানুর ফুলবাগান সবচে প্রিয়। ওখান থেকে কোথাও যেতে চায় না। সারা দিন বসে বসে ফুল, ঘাসফড়িং আর প্রজাপতিদের সঙ্গে গল্প করে।
গতবার একটি প্রজাপতির সঙ্গে অমির বেশ বন্ধুত্ব হয়েছিল। পিহু হচ্ছে সেই প্রজাপতি। ওকে বলেছিল বুটারফ্লাই মানে প্রজাপতি। পিহু বুটারফ্লাই উচ্চারণ করত আর অমির খুব হাসি পেত। তখন বলত ওটা বুটারফ্লাই না বাটারফ্লাই। বাটারফ্লাই মানে প্রজাপতি। পিহু বলত আমি কি তোমার মতো স্কুলে পড়ি নাকি যে পারব? এভাবে তাদের অনেক গল্প হতো। খুনসুটি আর গল্পে গল্পে সেবার অমির ছুটি শেষ হয়ে গিয়েছিল। বিদায় বেলায় অনেক কান্না করেছিল পিহু। অমি থেকে যাও না আমার কাছে। ওর যেতে ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু মা জোর করে নিয়ে এসেছিল। আসার সময় সে কি কান্না! অমি বাড়ি গিয়ে পিহুকে খুব মিস করত। ওর কিছু ভালো লাগত না। পিহুর সঙ্গে খুব গল্প করতে মন চাইত। হঠাৎ এক দিন ছাদবাগানে একটা হাসনাহেনা ফুলে প্রজাপতি বসেছিল। অমি ওকে অনেক ডেকেছিল কিন্তু সে শোনেনি। বরং অমিকে ভয় পেয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। তখন ভীষণ মন খারাপ করে অমি দুদিন ভাত খায়নি পর্যন্ত। যাকগে সেসব কথা।
আজ বাগানে এসে ফুলগুলোর সঙ্গে কথা বলল। পিহুর কথা ভুলে গিয়ে অনেক গল্প করল। হঠাৎ একটি প্রজাপতি উড়তে দেখে পিহুর কথা মনে পড়ল। সবাইকে জিজ্ঞাসা করল, পিহু কোথায়? ওর সঙ্গে দেখা করতে চায় অমি। সবাই চুপ চাপ বসে আছে। কেউ কিছু বলছে না অমিকে। অমি সবাইকে জিজ্ঞাসা করতে লাগল। ওদের মধ্য থেকে গন্ধরাজ ফুল বলে উঠল, পিহু মারা গেছে! এ কথা শুনে অমি থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কিছুক্ষণ পর অমি জিজ্ঞাসা করল, কীভাবে মারা গেছে আমার পিহু? সবাই বলল, বিল্টু পিহুকে ধরেছিল। পরে পিহুর ডানা ভেঙে গিয়েছিল। কিছুদিন ভীষণ অসুস্থ ছিল। এক দিন ঝড় উঠেছিল এই বাগানে। আমরা সবাই নিরাপদ জায়গায় যেতে পারলেও পিহুর ডানা ভাঙা ছিল। সেজন্য উড়ে যেতে পারেনি। বৃষ্টিতে ভিজে জবজবা হয়ে গিয়েছিল। বাগানের এখানে যে কাঁঠালগাছটি ছিল ওটা সেদিন ভেঙে পিহু ওপরে পড়েছিল। তখন পিহু এক্কেবারে মাটিতে মিশে গিয়েছে। আমরা আর ওকে দেখতে পাইনি। এসব বলে সবাই কান্না করতে লাগল।
অমি বলল, তোমরা আমাকে জানাওনি কেন? একজন বলল, আমাদের কি তোমাদের মতো মোবাইল ফোন আছে বা আমাদের কি অত বড় পাখা আছে যে উড়ে গিয়ে তোমাকে জানিয়ে আসব। সবাই কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর হাসনাহেনা বলল, ওই বাড়ির বিল্টু ধরেছিল পিহুকে। অমি ওখান থেকে নানুবাড়ি গেল। মন খারাপ করে বসে আছে। কারো সঙ্গে কথা বলছে না। রাতে না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ল। সকালে মা অনেক বলেছে, তাও খায়নি। ছোট মামা অমিকে পুকুর পাড়ে নিয়ে আদর করে জিজ্ঞাসা করলে অমি মামাকে সব বলে দিল। আর বলল, মামা? তুমি বিল্টুকে বকা দাও। যেন কাউকে আমার মতো পিহুকে না হারাতে হয়। তখনই মামা বিল্টুকে ডেকে এনে অনেক বকা দিল। আর কখনো যেন কোনো প্রজাপতি বা ফড়িং না ধরে এমন শপথ করাল। দেখতে দেখতে অমির ছুটি শেষ। এবার বাড়ি ফেরার পালা। বাগানের সবার কাছ থেকে বিদায় নিল অমি। আবার দেখা হবে বন্ধুরা। বাড়ি এসে অনেক দিন কেটে গেল। এক দিন স্বপ্নে পিহু এসে অমিকে ধন্যবাদ দিয়ে কিছু না বলেই চলে গেল। তারপর থেকে যখন কেউ পাখি, প্রজাপতি, ঘাসফড়িং এদের ধরতে চাইত অমি বাঁধা দিত। সেদিনই পিহু স্বপ্নে এসে অমিকে ধন্যবাদ দিয়ে চলে যেত আর অমির মন খারাপের দিনে পিহু স্বপ্নে এসে গল্প করে অমির মন ভালো করে দিত। এভাবেই পিহু মরে গিয়েও আজীবন অমির বন্ধু হয়েই থেকে গেল।
"