ইমতিয়াজ সুলতান ইমরান

  ১৩ আগস্ট, ২০২২

লাল-সবুজের ইরাবতী

ইরাবতী। এই ইরাবতী কোনো রাজকুমারী নয়। ইরাবতী নামটা শুনেই নদীর কথা মনে হয়। তবে নদী নয়। ইরাবতী নামে এক প্রকার ডলফিন আছে। এই ইরাবতী কোনো ডলফিন নয়। মনে পড়ে বিখ্যাত একটি স্থাপনার কথা। যে স্থাপনার নাম ছিল রাজকুমারী ইরাবতীর নামে। ইরাবতী পান্থশালা। তবে এই ইরাবতী কোনো স্থাপনা নয়। স্থাপনা না হলেও এই ইরাবতীকে স্থপতি বলা যায়। ছড়ার স্থপতি। গল্পের স্থপতি। ‘লাল-সবুজের আসর’ নামে ছোটদের কাগজের স্থপতি। ‘লাল-সবুজের আসর’ মানে ছোটদের ছড়ার আসর। কবিতার আসর। গল্পের আসর। ছবির আসর। ধাঁধার আসর। এক কথায় শিশুসাহিত্যের আসর।

ইয়াসমিন সুলতানা ইরা। লম্বা নাম। লম্বা নাম দাদুর পছন্দ নয়। দাদু বলেন, লেখকের নাম কাব্যিক, আনকমন এবং ছোট হওয়া ভালো। ছোট এবং আনকমন নাম সহজে পাঠকের মনে থাকে। সহজ হয় সম্পাদকের জন্যও। সম্পাদক পত্রিকায় লেখা ছাপাতে সমস্যায় পড়েন না। লম্বা নাম সেটিংয়ে সমস্যা হয়। এ সমস্যার কারণে, অনেক লেখা পত্রিকায় ছাপা হয় না। ছাপা হলেও অনেক সময় সম্পাদক লেখকের নাম ছোট করে ছাপেন। নাম ছোট করে ছাপলে লেখক মনে মনে কষ্ট পান। পত্রিকায় লেখালেখি করতে দাদুর যথেষ্ট প্রেরণা পায় ইরা। দাদুর মতে, শুধু লেখকের নাম নয়। সাহিত্যের কাগজের নামও কাব্যময় এবং অর্থবহ হতে হবে। নামকরণ হতে হবে নিজের চিন্তা-চেতনার সঙ্গে মিল রেখে। নামকরণে, চেতনার বীজ থাকে। যাচ্ছেতাই নামকরণে, সমালোচনার আশঙ্কা থাকে। দাদু ইয়াসমিন সুলতানা ইরাকে ছোট করে ইরাবতী নামে নামান্তর করলেন।

ইরার প্রশ্ন ছিল, আমি ইরাবতী নামে লিখব কেন? আমার নাম তো ইরাবতী নয়। আমার নাম, ইয়াসমিন সুলতানা ইরা। দাদু বলেছিলেন, তুমি ছদ্মনামে লিখবে। ইরাবতী হলো তোমার ছদ্মনাম। ইরা থেকে ইরাবতী। বেশ মিল। বেশ মানানসই। ইরা জানতে চেয়েছিল ছদ্মনাম কী? দাদু বুঝিয়ে বলেছিলেন, ছদ্মনাম হলো, পরিচয় গোপন রেখে যে নাম ব্যবহার করা হয়। পরিচয় গোপন রাখব কেন? দাদু বোঝালেন, লেখালেখির শুরুতে অনেকেই পরিচয় গোপন রাখেন। ছদ্মনামে লেখার প্রধান কারণ হলো, তিনি কেমন লেখেন। তার লেখা পাঠকের কতটা মন কাড়ে? সেটা দেখতে চান। তিনি যদি পাঠকের মাঝে সমাদৃত হন। পরিচিতি পান। প্রতিষ্ঠা পান। তাহলে আসল পরিচয় এমনিতেই প্রকাশ পায়। আমি চাই, তুমিও ছদ্মনামে লেখো। ইরাবতী নামেই লিখে যাও। ইরাকে আরো কিছু তথ্য জানানোর জন্য দাদু বলেছিলেন, ছদ্মনামে অনেক কবি-সাহিত্যিক লেখালেখি করেছেন। এটাকে ইংরেজিতে ‘পেন’ নেম এবং বাংলায় ছদ্মনাম বলে। ছদ্মনামে লেখালেখির রীতি অনেক আগে থেকেই প্রচলিত। অনেক লেখক ছদ্মনামে খুব বিখ্যাত হয়েছেন। অনেক লেখক জীবনের শুরুতে, আবার কেউ কেউ সারা জীবন লেখালেখির ক্ষেত্রে ছদ্মনাম ব্যবহার করেছেন। যেমন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একসময় নীললোহিত নামে লিখেছেন। কাজেম আলী কোরেইশী লিখেছেন, কায়কোবাদ নামে। প্রমথ চৌধুরী, বীরবল নামে। কালীপ্রসন্ন সিংহের ছদ্মনাম ছিল, হুতুম প্যাঁচা। মীর মশাররফ হোসেন লিখেছেন, গাজী মিয়া নামে। এ রকম অসংখ্য খ্যাতিমান লেখক আছেন, যারা ছদ্মনামে লেখালেখি করেছেন। সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে খ্যাতনামা সাহিত্যিকদের পাশাপাশি অল্পখ্যাত লেখকও ছদ্মনাম গ্রহণ করেছেন। কেউ কেউ এটাকে নামান্তর বলে থাকেন।

ইরাকে ইরাবতী নামে নামান্তর করেছিলেন দাদু। দাদু জানতেন, ইরাবতী পরিচিত নাম। বিখ্যাত নাম। ছোট্ট নাম। নামের মধ্যে কাব্যময় ভাব আছে। মাধুর্য আছে। দাদু ভেবেছিলেন, বর্তমান সময়ে ইরাবতী নামে কেউ লেখালেখি করলে পাঠকের মনে আগ্রহ দেখা দেবে। আরো জানালেন, ইরাবতী হচ্ছে একটি নদীর নাম। এটি প্রাচীন উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় ভারত ও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান অতিক্রম করা একটি আন্তসীমা নদী। এই নদী পাঞ্জাব অঞ্চলের সিন্ধু প্রণালির ছয়টি নদীর একটি। এক প্রকার ডলফিন মাছের নামও ইরাবতী। তা ছাড়া ইরাবতী নামে বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে অবস্থিত একটি পান্থশালা ছিল। এই পান্থশালাটি ছিল, একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা। সিলেট অঞ্চলের জৈন্তিয়ার রাজকুমারী, ইরাবতীর নামে এই স্থাপনার নাম। দাদু আরো জানিয়েছিলেন, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার লেখালেখির জীবনে নয়টি ছদ্মনাম ব্যবহার করেছেন। এগুলো হলো, ভানুসিংহ ঠাকুর, অকপটচন্দ্র ভাস্কর, আন্নাকালী পাকড়াশী, দিকশূন্য ভট্টাচার্য, নবীন কিশোর শর্মণ, ষষ্ঠীচরণ দেবশর্মা, বানীবিনোদ বিদ্যাবিনোদ, শ্রীমতী কনিষ্ঠা ও শ্রীমতী মধ্যমা।

দাদুর কথা শুনে ইরা খুব খুশি হয়েছিল। খুশি হয়ে ইরাবতী নামে লেখালেখি শুরু করে। ইরার খুব কাছের গুরু হলেন, দাদু। কিছু লিখলেই দাদুকে দেখায়। দাদু ইরাবতীর প্রতিভা দেখে খুশি হন। ইরার লেখালেখির দুর্বল স্থানগুলো ধরিয়ে দেন। বুঝিয়ে দেন। বোঝালেন, ছড়া, কবিতার ছন্দ কী? গল্প কেমন করে লিখতে হয়। কীভাবে শুরু ও শেষ করতে হয়। শব্দ চয়ন। শব্দ বুনন। ছন্দ কোথায় থাকে। পর্ব ও মাত্রা। অন্ত্যমিল কী। মধ্যমিল কী। শব্দ ভেঙে অক্ষর তৈরি। কোন অক্ষর, কোন ছন্দে, কত মাত্রা। দাদু এসব হাতে-কলমে শিখিয়েছেন। ইরাকে নিয়ে দাদু ঘুরতে বেরোতেন। প্রকৃতি দেখাতেন। দাদুর পরামর্শ ছিল, ভালো লিখতে হলে, প্রকৃতির কাছে যেতে হবে। প্রকৃতির রূপ দেখতে হবে। প্রকৃতিকে চিনতে হবে। প্রকৃতির বন্ধু হতে হবে। শুধু প্রকৃতির বন্ধু হলেই চলবে না। বইয়ের সঙ্গেও ভালো বন্ধুত্ব থাকতে হবে। প্রচুর বই পড়তে হবে। যত বেশি পড়বে তত ভালো লিখতে পারবে। ভালো লিখতে হলে পড়াশোনার কোনো বিকল্প নেই। অবশ্যই প্রচুর পড়াশোনা করতে হবে। ইরাবতী দাদুর দেওয়া পরামর্শ শুনে রীতিমতো প্রকৃতি ও বইয়ে পোকা হয়ে ওঠে।

ইরাবতী এখন কলেজে পড়ে। এসএসসি পাস করে কলেজে ভর্তি হয়েছে। বাড়ির পাশেই কলেজ। কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক খান মোহাম্মদ আবুল কালাম স্যার। বাংলা স্যার অনেক রসিক হন। কিন্তু এই অধ্যাপক স্যার একটু অন্যরকম। স্কুলের বাংলা স্যার বেশ মজার। স্যারের নাম তন্ময় রায়। তন্ময় স্যার ইরাবতীর লেখালেখির প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। বেশ উৎসাহ দিতেন। লেখালেখির ক্ষেত্রে স্কুলে থাকতেই বেশ পরিচিতি পেয়েছে ইরাবতী। ইরাবতী নামটি পাঠকমহলে বেশ পরিচিত। স্থানীয় দৈনিক, জাতীয় দৈনিক, দেশের মানসম্মত ছোটদের কাগজ, বিভিন্ন প্রিন্ট এবং অনলাইন পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখি করছে। পত্রিকার ছোটদের পাতায়, ছোটদের ম্যাগাজিনে, দেশের খ্যাতিমান লেখকের পাশে প্রকাশ হয় ইরাবতীর ছড়া, কবিতা ও গল্প। খ্যাতিমান শিশুসাহিত্যিকদের সারিতে সূচিবদ্ধ হয় ইরাবতীর নাম। কলেজের শিক্ষক-শিক্ষিকা, ছাত্রছাত্রীর খুব প্রিয় হয়ে ওঠে। কলেজে ইরাবতীর নাম ইয়াসমিন সুলতানা ইরা হলেও শিক্ষক-শিক্ষিকা, ছাত্রছাত্রী কেউ ইয়াসমিন বা ইরা নামে ডাকেন না। সবাই ডাকেন ইরাবতী। ইরাবতীকে নিয়ে শুধু দাদুর গর্ব নয়। ইরাবতী স্কুল-কলেজ ও এলাকার গর্ব। দাদু বলেন, ইরাবতী আমাদের দেশের গর্ব।

দাদুর প্রেরণায় ইরাবতী ‘লাল-সবুজের আসর’ নামে একটি ছোটদের কাগজ বের করতে চায়। কাগজের নামকরণ নিয়ে ইরাবতীকে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। পরামর্শ চেয়েছিল তার কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক খান মোহাম্মদ আবুল কালাম স্যারের এবং তার স্কুলের বাংলার শিক্ষক তন্ময় রায় স্যারেরও। স্কুল আর কলেজের দুই স্যারকে রাখতে চেয়েছিল উপদেষ্টা হিসেবে। খান মোহাম্মদ আবুল কালাম স্যারকে প্রধান উপদেষ্টা রেখে ম্যাগাজিনের সুন্দর এবং অর্থবহ একটি নামকরণ ছেয়েছিল। অধ্যাপক স্যার নামকরণ করেছিলেন, ‘নীল সবুজের আসর’। ইরাবতী বলেছিল, দাদু বলেছেন, ‘লাল-সবুজের আসর’ হলে অর্থবহ নাম হবে। কিন্তু অধ্যাপক স্যার ‘নীল-সবুজের’ পক্ষে যুক্তি দেখিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, নীল, আকাশের রং। আকাশ উদার। আকাশে চাঁদ, তারা, জোছনা, সূর্য, আলো, বায়ু, মেঘ, খেলা করে। এসব কবির প্রিয়। এসব নিয়ে কবিরা কবিতা লেখেন। তাই ‘নীল-সবুজের আসর’ অর্থবহ এবং সুন্দর নাম। আর ‘লাল-সবুজের’ বিপক্ষে যুক্তি দেখিয়েছিলেন, লাল হলো, রক্তের রং। ছোটদের কাগজে এসব রক্তারক্তি শোভা পায় না। কিন্তু দাদু আর তন্ময় স্যার অধ্যাপক স্যারের নামকরণ মানতে পারেননি। দাদু একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। একজন খ্যাতিমান কবি। তিনি ইরাবতীকে মুক্তিযুদ্ধের বহু লোমহর্ষক গল্প শুনিয়েছেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানিয়েছেন। জাতির পিতার অবদান জানিয়েছেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার ঘটনা বলেছেন। ইরাবতীও মুক্তিযুদ্ধের ওপর রচিত ছোটদের অনেক বই পড়েছে। পাঠ্যবইয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জেনেছে। সেই চেতনায় সে লেখালেখিও করছে। দাদু বুঝতে পেরেছিলেন, ওই অধ্যাপক, ইরাবতীর কাগজকে কৌশলে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায়। অধ্যাপক আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও মহান স্বাধীনতার চেতার বিরোধিতা করতে চায়। দাদু জানতেন, অধ্যাপকের বাবা ছিল স্বাধীনতাবিরোধী লোক। অধ্যাপকও সেই দলেরই। এখনো তাদের উত্তরসূরিরা আড়ালে, আবডালে বসে দেশের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র করছে। দাদু ইরাবতীকে বুঝিয়ে বলেছিলেন, লাল-সবুজ মানে, আমাদের পতাকা। সবুজ আমাদের দেশ। লাল হচ্ছে স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য। সবুজের মাঝে লাল মানে, গাছের ফাঁকে সূর্যের আলো। পুবের আকাশে ভোরের রাঙা সুরুজ। ‘লাল-সবুজ’ মানেই আমাদের বিজয় নিশান। লাখো শহীদের রক্তে অর্জিত স্বাধীনতা। দাদুর কথা শুনে ইরাবতী বলল, এসব আমি জানি দাদু। তুমিও আমাকে বহুবার বলেছো। আমাদের স্বাধীনতা মানেই বঙ্গবন্ধু। ‘লাল-সবুজ’ মানেই সোনার বাংলা। আমাদের প্রিয় পতাকা। প্রিয় বাংলাদেশ।

‘লাল-সবুজের আসর’ ম্যাগাজিনের নির্বাহী সম্পাদক ইরাবতী। প্রধান সম্পাদকের দায়িত্বে আছেন দাদু। প্রধান উপদেষ্টা তন্ময় রায় এবং দাদুর চেনাজানা আরো কয়েকজন। মাসিক ‘লাল-সবুজের আসর’। নিয়মিত প্রকাশ হয়। নিয়মিত লিখছেন, দেশ-বিদেশের বাংলাভাষী খ্যাতিমান শিশুসাহিত্যিকসহ অনেক নবীন, উদীয়মান, সম্ভাবনাময়ী ছড়াকার, গল্পকার। নিয়মিত আঁকাআঁকি করছে দেশের বিভিন্ন স্কুলপড়ুয়া কোমলমতি শিশুরা। লেখক ও পাঠকমহলে নন্দিত নাম শিশুসাহিত্যিক ও সম্পাদক ইরাবতী। লাল-সবুজের ইরাবতী।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close